অবরোধে বাসের আগুনে মৃত্যু
চলছে না হেলপার নাঈমের পরিবার, কেউ রাখছে না খোঁজ
বিএনপি-জামায়াতের অবরোধ চলাকালে দেড় মাস আগে রাজধানীর ডেমরায় দুর্বৃত্তদের আগুনে বাসের ভেতরে ঘুমন্ত অবস্থায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া নাঈমের পরিবারের খোঁজ কেউ রাখেনি। সরকারি দল, আন্দোলনকারী, বাস মালিক সকলেই সামাজিক-শান্তনা দিয়ে একদম চুপচাপ।
তবে, এই মৃত্যুতে কারও কিছু হোক আর না হোক- বাস চালকের সহকারী ২২ বছর বয়সী নাঈমের পরিবারে নেমে এসেছে অজানা অন্ধকার। একমাত্র উপার্জনক্ষম নাঈমকে হারিয়ে পরিবার এখন অথৈই সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। তিনবেলা খাবার জোগাতে হিমশিম খাচ্ছেন। নাঈমের ছোট দুই ভাইয়ের পড়াশোনা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। কারণ- নাঈমের টাকায়ই চলত এই সংসার, চলত ভাইদের পড়াশোনা। পরিবারে স্বচ্ছলতা না থাকায় পড়াশোনা করা হয়নি নাঈমের। পরে বাসের শ্রমিক হয়েই স্বপ্ন দেখছিলেন ভাইদের পড়াশোনা করিয়ে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার বানানোর। কিন্তু সেই স্বপ্ন এখন ধুলোয় মিশে গেছে।
এমন কথাই জানালেন বরিশাল চরমোনাই দুঃসহ জীবন কাটানো ছেলে হারা নাঈমের মা পারভীন বেগম। তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ছেলেটাকেও হারালাম। আর ছেলের লাশ ঢাকা থেকে আনতে গিয়ে ৮০ হাজার টাকা লেগেছে। বাসমালিক বা সরকার কেউ একটি টাকাও দেয়নি। নাঈম যে অছিম বাসে চাকরি করত সেই বাসের কর্মচারীরা সবাই চাঁদা তুলে ৪০ হাজার টাকা দিয়েছে। আর ডেমরা থানার ওসি কিছু টাকা দিয়েছেন। বাকি টাকা ধারদেনা করে ছেলের লাশ বাড়িতে এনে দাফন করেছি।
নাঈমের মাকে সামান্য কিছু টাকা সাহায্য করার কথা জানিয়ে ডেমরা থানার ওসি জহিরুল ইসলাম ঢাকা টাইমসকে বলেন, এ টাকা আমি ব্যক্তিগতভাবে দিয়েছে। অল্প কিছু টাকা।
গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশের পর একইদিন গভীর রাতে রাজধানীর ডেমরায় অছিম পরিবহনের একটি বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এতে বাসের ভিতর ঘুমে থাকা অছিম বাস চালকের সহকারী নাঈম (২২) মারা যায়। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে সবার বড় নাঈম। বোন বিয়ে দিয়েছে। কিন্তু পরিবার ও ছোট দুই ভাইয়ের পড়াশোনা চলত নাঈমের পাঠানো টাকায়। সেই উপার্জনক্ষম ছেলেকে হারিয়ে দিশেহারা মা পারবিন বেগম। নাঈমের বাড়ি বরিশাল জেলা চরমোনাই ইউনিয়নে।
ছেলের প্রসঙ্গে কথা বলতেই কেঁদে ফেলেন নাঈমের মা পারভীন বেগম। তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলে ছিলো আমার নাঈম। প্রতি মাসে বাড়িতে ১৫ থেকে ১৮ হাজার টাকা পাঠাত। ওর টাকা দিয়েই সংসার ও দুই ছেলে পড়াশোনা চলত। এক ছেলে পড়ে দশম শ্রেণিতে ও আরেক ছেলে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। এখন পড়াশোনার খরচ সংসার চালানো খরচ জোগানো মত কেউ নেই। ছেলের বাবা থাকলেও তার তেমন আয় রোজগার নেই।
পারবিন বেগম বলেন, নাঈমের লাশ ঢাকা থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে গ্রামে বাড়িতে আনতে প্রায় ৮০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু বাস মালিক কোনো টাকা পয়সা দেয়নি। ছেলের মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকে ঢাকায় বারবার আস যাওয়াসহ নানা খরচে আমাদের পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছে। সংসার নিয়ে আমি এখন বড় কষ্টে আছি।
ছেলের মৃত্যুতে এখন পর্যন্ত কেউ কোনো প্রকার ক্ষতিপূরণ দেয়নি জানিয়ে পারভীন বলেন, এ ঘটনায় সরকারবাদী মামলা হয়েছে। আর আমরা থাকি গ্রামে, আমরা মামলা করে আর কী করতে পারব! আমরা গরীব মানুষ মামলা করে কী পারমু।
বাস মালিক থেকে যোগাযোগ করে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, তারা সরকারের কাছে আবেদন করেছে, সরকার কিছু ক্ষতিপূরণ দিলে তখন আমাদের দেওয়া হবে। কিন্তু বাস মালিকের পক্ষ থেকে কিছু দেয়নি।
অছিম পরিবহনের এমডি কাওসার ঢাকা টাইমসকে বলেন, সরকারের সাহায্যের জন্য যে আবেদন করা হয়েছে, তার ফলাফল নির্বাচনের পর ছাড়া পাওয়ার সম্ভবনা খুব কম।
নাঈমের মা বলেন, খুব কষ্টে আছি, যা অন্যের কাছে বলাও যায় না। আমার সংসারে যে কত অভাব, তা আমি কারো কাছে বলতে পারি না। এলাকার চেয়ারম্যান মেম্বারও সাহায্য করে না। বড় ছেলে নাঈম মাস গেলে ১৫ থেকে ১৮ হাজার টাকা পাঠাত। তা দিয়ে দুই ছেলে পড়াশোনা ও ঘরের বাজারঘাট হতো। বড় ছেলে মারা যাওয়ায় সংসার মনে হয় থেমে গেছে। আর দুই ছেলে পড়াশোনাও চালিয়ে নেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
নাঈমের দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া ভাই ফাহিম হোসেন বলেন, ভাইকে হারিয়ে অথৈয় সাগরে পড়েছি মনে হয় আমরা। পড়াশোনা চালিয়ে নেওয়া নিয়ে আমরা এখন দুশ্চিন্তায় আছি। ঠিক মতো খাওয়াই এখন দায়!
পারভীন বেগম বলেন, আমার তিন ভাই অছিম পরিবহনের বাস চালায়। তারা বিভিন্ন বাস থেকে চাঁদা তুলে ৪০ হাজার টাকা দিছে। এসব কথা মানুষের কাছে বলতেও তো লজ্জা হয়।
আক্ষেপ করে নাঈমের মা বলেন, বাস মালিক গাইড থেকে ২০ হাজার ৫০ হাজার টাকা দিত! কিন্তু তা তো দিল না। আমার ছেলে সাত বছর তাদের বাসে চাকরি করেছে। তাদের তো মালিক সমিতি আছে, সেখান থেকে তো দিল না একটা টাকাও! আমি গরীব আমার ছেলেও গেছে আবার ডেমরা আমার ভাইরা থাকে, তাদের ওপর চাপ উঠবে এ কারণেও আমি কিছু বলি নাই। আমার ভাইরা বাস থেকে চাঁদা তুলে দিছে। বাস মালিক কোনো টাকা দেয়নি। ছেলের মরদেহ মর্গে থেকে বের করতে টাকা লাগছে, লাশের গোসল করাতে টাকা লাগছে, লাশের বাক্স কিনতে টাকা লাগছে। সব মিলিয়ে প্রায় ৮০ হাজার টাকা গেছে আমার। এখন আমি দিশেহারা।
(ঢাকাটাইমস/১৯ ডিসেম্বর/টিআই/বিবি)