চলমান সমাজই সামাজিক মর্যাদার সৌরভ ছড়াতে পারে

এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার
 | প্রকাশিত : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১০:২২

দেশব্যাপী আসন্ন উপজেলা নির্বাচনকে ঘিরে ইতোমধ্যে ইতিবাচক স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে সমাজের সর্বস্তরের শ্রেণি-পেশার সকল মর্যাদার নাগরিকগণ। জাতীয় সংসদ নির্বাচনোত্তর সরকারের কিছু নীতিগত সিদ্ধান্ত নাগরিকমনে দীর্ঘকালের অপসংস্কৃতির নেতিবাচক প্রভাব থেকে উত্তরণের পথ দেখাচ্ছে। অস্বচ্ছ মননের কিছু রাজনৈতিক নেতৃত্বের নেতিবাচক প্রভাবের বলয় থেকে মুক্ত হতে সাধারণ মানুষ আবার নতুন করে স্বপ্নের বীজ বপন করতে শুরু করেছে আপন আপন সমাজ ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে।

রাজনৈতিক চর্চায় প্রায় প্রতিটি দলের নির্বাচিত সংসদ সদস্যগণের অনেকেই নিজস্ব পন্থায় তৃণমূল পর্যায়ে নেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে একচেটিয়ে প্রভাব বিস্তার করে এসেছে। কিছু ব্যতিক্রম আছে যা সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। সংগঠনের অনেক ত্যাগী নেতা-কর্মীকে বঞ্চিত করে স্বজনপ্রীতি কিংবা নিজের স্বার্থসিদ্ধির প্রয়োজনে নিজ দলের কিছু অযোগ্য সদস্যদের কাছ থেকে সুবিধা গ্রহণ করে যোগ্যতার মাপকাঠি থেকে বিচ্যুত হয়ে তাদেরকে বিভিন্ন সাংগঠনিক পদে নেতা নির্বাচন করার প্রবণতা দেখা যায় বহু সংসদ সদস্যগণের মধ্যেই। এমনকি, কখনো কখনো অন্য দল থেকে ভিন্ন কোনো সুবিধা নিয়ে নিজ দলে বড়ো বড়ো সাংগঠনিক পদে দায়িত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে নামকাওয়াস্তে কিছু নিয়মকানুন কাগজে-কলমে দেখিয়ে নিজ দলের নেতা বানিয়ে দেওয়ার উদাহরণও পত্রপত্রিকায় চোখে পড়ে। আরেকটি বিশেষ বিষয় লক্ষণীয় যে- তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের ভাগ্য নির্ধারণে বেশ লম্বা একটা সময় ধরে প্রায় সকল দলেই 'টপ ডাউন অ্যাপ্রোচ'- অর্থাৎ কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যায়ে নেতা চাপিয়ে দেওয়ার পদ্ধতিই অনুসরণ করতে দেখা যায়। এমনও ঘটনা ঘটছে যে, তৃণমূল পর্যায়ে যাকে কোনোদিন রাজনীতি করতেই দেখাই যায়নি, কিংবা অসময়ে দলের জন্য যে কোনোই ভূমিকা রাখেনি কোনোদিন, সেই ব্যক্তিও তোষামোদী করে কিংবা অন্য কোনো পন্থায় সিনিয়র নেতাদের পিএস, এপিএস ইত্যাদি পরিচয় ধারণ করে প্রতারণার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় নেতাদের খুশি করে স্থানীয় পর্যায়ে নেতা বনে যান। ফলে সংগঠনের আদর্শ ধারণ করে কর্মীবান্ধব এবং জনবান্ধব রাজনীতিতে তারা সমাজ সন্তুষ্টিতে পুরোপুরি ব্যর্থ হচ্ছে।

অন্যদিকে ছাত্র সংগঠন থেকে শুরু করে মূল সংগঠন পর্যন্ত নানা পর্যায়ে জীবন বাজি রেখে যারা দল এবং জনগণের পাশে থেকে রাজনীতি করে দলীয় নেতা হবার চেষ্টা করেছে, তাদের অনেকেই 'বটম টু টপ' অ্যাপ্রোচের রাজনৈতিক সংস্কৃতি না থাকার কারণে রীতিমতো হতাশ হয়ে রাজনীতি থেকে অবসর, স্বেচ্ছায় নিস্ক্রিয় হয়ে যাওয়া কিংবা সরে দাঁড়াবার প্রয়াসকে বাধ্য হয়ে বেছে নিতে দেখা যায়। নেতা হবার সৌভাগ্যযোগ না থাকলেও দল এবং আদর্শিক রাজনীতির স্বার্থে এদের বেশিরভাগই জেল-জুলুমের শিকার হয়েছে। বড়ো দলগুলোতে এমনিতেই সভাপতি, সেক্রেটারি এমনকি সাংগঠনিক সেক্রেটারিকেন্দ্রিক বিভিন্ন গ্রুপ বা রাজনৈতিক উপদলে বিভিন্ন বিভাজন রয়েছে। স্থানীয় রাজনীতিকে কেন্দ্র করে তারা উপজেলা পর্যায়ে প্রত্যেকেই জনপ্রতিনিধি হয়ে ক্ষমতার মসনদে বসতে চায়। এ চাওয়াটা খুব ন্যায়সংগত এবং স্বাভাবিক। তদুপরি, ঐ সকল এলাকাভিত্তিক অনেক সংসদ সদস্যই বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রদানের মধ্য দিয়ে দলীয় সাংগঠনিক কমিটিকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিজের করায়ত্তে জিম্মি করে রাখতেই অভ্যস্ত। ফলে তার মনোনীত প্রার্থী সকল বিবেচনায় অযোগ্য হলেও যোগ্যতম প্রার্থীরা দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে ইচ্ছার বিরুদ্ধে অযোগ্য প্রার্থীর পক্ষে জনসাধারণের কাছে ভোট চাইতে বাধ্য হয়। কিছু ব্যতিক্রম পরিলক্ষিত হলেও, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই সকল যোগ্যতর প্রার্থী দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নির্বাচন করতে চান না, কেননা দলীয় নিয়ম শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে তাদেরকে শাস্তির আওতায় আসতে হয়।

চলমান এমন একটি প্রক্রিয়ায় সমাজের মানুষের চারিত্রিক দৃঢ়তা কমতে কমতে প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। গল্প আছে- একবার একজন প্রার্থী এক ভোটারকে আহ্বান করছিলেন এই বলে যে- ‘চাচা আসুন এক কাপ চা খাই।’ প্রতিত্তোরে চাচা বললেন- ‘চা খেয়ে আর কী হবে? গতবছর তিন হাজার টাকা দিয়ে ভোট কিনেছিলে, এবার ৫ হাজার টাকা দিয়ে যাও।’ কৌতূহলে তাকে জিজ্ঞেস করলেন- ‘চাচা এবার ২০০০ টাকা বেশি কেন?’ চাচা উত্তর দিলো- ‘আমি অপরাধ না করেও তোমার এক বিচারে ৫০০০ টাকা জরিমানা দিয়েছি, তোমার তা ভুলে যাবার কথা নয়। এমনকি জরিমানা দিয়েও অপমানের হাত থেকে রেহাই পাইনি তোমাদের বিচারে। প্রাণনাশের আশঙ্কা থেকে অপমানের মূল্যটুকু আর চাইলাম না।’

এরকম হাজারো অভিজ্ঞতা নিয়ে বসবাস করছে সমাজের মানুষ; আর দিন যত গড়াচ্ছে- ততটাই রাজনীতির প্রতি, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের প্রতি অনীহা বাড়ছে সাধারণ মানুষের। সংখ্যাবিচারে খুব কম, তবে কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে যাদের সংখ্যা সামাজিক ভারসাম্য রক্ষায় অনেক অনেক বেশি হওয়া প্রয়োজন।

বেশ পূর্বে সমাজে রাজনৈতিক সংস্কৃতির বাইরে থেকে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার বহু সুধীজন গুণিজনের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেখা যেত। এমনকি অনেকেই চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান পদে স্বতন্ত্র হিসাবে জনগণের ম্যান্ডেড নিয়ে ক্ষমতার মসনদে বসেছেন। পেশিশক্তিভিত্তিক রাজনৈতিক প্রভাব বেড়ে যাওয়ায় রাজনৈতিক শক্তির বাইরের প্রার্থীদের এক্ষেত্রে অংশগ্রহণের প্রবণতা কমতে কমতে রীতিমতো কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। বর্তমানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উপজেলা নির্বাচনের ক্ষেত্রে দলীয় প্রতীক বরাদ্দ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এমনকি, দলীয় সাংসদদের এক্ষেত্রে পূর্বের ন্যায় তার নিজস্ব মনোনীত কোনো প্রার্থী কিংবা দল থেকে যেই নির্বাচন করুক না কেন, কারো পক্ষ অবলম্বন করতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। নেতাকর্মীরা তাদের পছন্দের যেকোনো প্রার্থীর সাথেই শৃঙ্খলা বজায় রেখে নির্বাচনি প্রচার কাজে অংশগ্রহণ করতে আর কোনো অসুবিধা রইলো না। তাতেই জেগে উঠতে শুরু করেছে সমাজের নতুন মনন।

আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে সমাজের নতুন চরিত্র অভিন্নভাবে দুটি ক্ষেত্রে খুব স্পষ্ট করেই চোখে পড়ে। অঞ্চলভিত্তিক কিছু মাহফিল নির্দিষ্ট পরিসরে কিছু মসজিদ মাদ্রাসা এতিমখানা ইত্যাদিকে ঘিরে নিজেদের বিভিন্ন ধর্মীয় বয়ানকে সমাজে বিশেষ বিশেষ কিছু বক্তা তাদের আর্থিক উপার্জনের অনেকটা মনোপলি মার্কেট হিসেবেই বিবেচনা করতো। অনেক ক্ষেত্রে একই ধর্মের অন্য ঘারানার বক্তাদের প্রভাবকে সহজে মেনে নিতে না পারায় তারা একে অপরের প্রতি বিষোদ্গার করতে কেউ কাউকে এতটুকুও যেমন ছাড়েন না, তেমনি করে রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও সমাজে এমনকিছু অপরাজনৈতিক নেতৃত্বের জন্ম হয়েছে- যেখানে একইভাবে আর্থিক সুবিধাভোগের কারণে সেখানে জনপ্রতিনিধির লড়াইয়ে অন্য কোনো শ্রেণি-পেশার মানুষের আগমন ঘটুক- তা প্রকাশ্যে কিংবা অপ্রকাশ্যে ঐ সকল নেতৃত্বের কেউই চায় না- যা তাদের আচরণে খুব স্পষ্টভাবেই ফুটে ওঠে। এই যখন সমাজের অবস্থা, তখন সাধারণ মানুষ একই বক্তার বক্তব্য বারবার শ্রবণ করতে যেমন বাধ্য হন, তেমনি করে জনপ্রতিনিধি বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও আজকাল অন্য কোনো শ্রেণি-পেশার বিকল্প সুযোগ্য ও দক্ষ নেতৃত্বকে বেছে নেবার সুযোগ পাওয়াটা খুব ভাগ্যেরই বিষয় হয়ে পড়েছে।

মানুষের সামাজিক সাংস্কৃতিক মননে এমন একটি স্থায়ী ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে যে- ভোট উৎসবে স্বতঃস্ফূর্ততার বেশ অভাব পরিলক্ষিত হতে শুরু করেছে। সাধারণ জনগণ ও কর্মীবান্ধব মিষ্টভাষী নেতার বড়োই সংকট সৃষ্টি হয়েছে- এটি যেমন সত্য, অপরদিকে শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-গরিমা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের অবনমনের ধারা মানুষের অধিকার এবং সচেতনতার মাত্রাকে ক্রমান্বয়ে পশ্চাৎমুখী প্রতিক্রিয়াশীল করে ফেলছে- তা বলাই যায়। যে কারণে অভূতপূর্ব উন্নয়নও মানুষের মনে যতটা দাগ কাটবার কথা, যতটা গর্ব অনুভব করবার কথা, ঠিক ততটা উচ্ছ্বলতা আজ চোখে পড়ে না। ধর্ম, সমাজ, শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ইত্যাদি নানা বিষয়কে কেন্দ্র করে সজ্ঞানে-অজ্ঞানে কিংবা ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে নানামুখী অকথ্য, অসত্য, হিংসা, বিদ্বেষ, দলাদলি, মারামারি প্রভৃতি নানারকম নেতিবাচক উপসর্গে আজ সমাজটা নিমজ্জিত। এই প্রেক্ষাপট থেকে সমাজকে মুক্ত করে কাঙ্ক্ষিত কল্যাণমুখী সমাজে পরিণত করতে জনবান্ধব, সুযোগ্য, সুশিক্ষিত, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন, নির্মোহ, নির্লোভ ও সুদক্ষ জনপ্রতিনিধি বর্তমান সমাজে খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। আসন্ন উপজেলা পৌরসভা এবং ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনগুলোতে এমন কাঙ্ক্ষিত জনপ্রতিনিধিরা সুষ্ঠুভাবে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে নবপ্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য স্মার্ট আধুনিক সমাজ গড়ে তুলবেন- এমনটাই প্রত্যাশা করি।

এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার: পুলিশ সুপার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :