দুরন্ত মাশরাফির উড়ন্ত ১৫

জহির উদ্দিন মিশু, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ০৮ নভেম্বর ২০১৬, ১১:৫৭ | প্রকাশিত : ০৮ নভেম্বর ২০১৬, ০৯:৩৩

৮ নভেম্বর। স্মৃতির পাতায় আজও চিরঅম্লান। সেদিন লাল-সবুজের জার্সিতে পথচলা শুরু হয় বাংলাদেশ ক্রিকেটের অন্যতম মহানায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজার। ২০০১ থেকে ২০১৬। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের ১৫টি বছর পার করলেন এই টাইগার সুপারস্টার। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় তাঁর সঙ্গী হয়েছে অসংখ্য হর্ষ-বিষাদ।

বয়স তখন ১৮ ছুঁইছুঁই। ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্ট ক্যাপ মাথায় উঠে মাশরাফির। পেসার মাশরাফির মাঠের শুরুটা হয়েছিল ব্যাট হাতে। প্রথম দিন ৪৫ মিনিট ক্রিজে থেকে ২২ বল থেকে করেছিলেন ৮ রান। বৃষ্টির বাগড়ায় ম্যাচটি অমীমাংসিত থেকে যায়। কিন্তু অভিষেকেই মাশরাফি তাঁর জাত চিনিয়েছেন। ১০৬ রানে তুলে নেন ৪টি উইকেট। তাঁর প্রথম শিকার ছিলেন সে সময়কার তারকা ক্রিকেটার গ্র্যান্ট ফ্লাওয়ার।

তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি মাশরাফিকে। দুর্বার গতিতে এগোতে থাকে তাঁর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার। নানা চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করেন ১৫ বছর। ক্রিকেটে মহলে ছড়িয়ে পড়ে মাশরাফির নাম-ডাক। ঝুলিতে পুরে একাধিক খেতাব। স্থান করে নেন ক্রিকেটপ্রেমীদের মনের মণিকোঠায়।

২০০৪ সালে ভারতের বিপক্ষে একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে জয়লাভ করে বাংলাদেশ। সেই অবিস্মরণীয় জয়ের নায়ক ছিলেন মাশরাফি। ২০০৬ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট ম্যাচে বল হাতে দ্যুতি ছড়ান মাশরাফি। বাংলাদেশি বোলারদের মধ্যে তাঁর গড় ছিল সবচেয়ে ভালো। কার্ডিফে অস্ট্রেলিয়ার বধের চিত্রনাট্যটাও তাঁর হাত দিয়ে রচিত। ওই ম্যাচে মারকুটে ব্যাটসম্যান অ্যাডাম গিলক্রিস্টকে শূন্য রানে ফেরান তিনি। সে বছর ৪৯টি উইকেট নিয়ে মাশরাফি ছিলেন একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বিশ্বের সর্বাধিক উইকেট শিকারি।

২০০৭ সালে বিশ্বকাপের মঞ্চে ভারতের বিপক্ষে অসাধারণ জয় তুলে নেয় বাংলাদেশ। ওই ঐতিহাসিক জয়ে ৩৮ রানে ৪ উইকেট নিয়ে ক্রিকেট বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেন মাশরাফি। ২০১৬ সালের বাংলাদেশ-ইংল্যান্ড ওয়ানডে সিরিজের তৃতীয় ম্যাচে দুই উইকেট সংগ্রহের মাধ্যমে মোট ২১৬ উইকেট ঝুলিতে পুরেন মাশরাফি। সেই সুবাদে বাংলাদেশি বোলার হিসেবে ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারির খাতায় নাম লেখান মাশরাফি।

কেবল বোলার নয়, ব্যাটসম্যান হিসেবেও রয়েছে তাঁর খ্যাতি। ভারতের বিপক্ষে ঢাকায় অনুষ্ঠিত একদিনের ক্রিকেটে পরপর চার বলে ছক্কা হাঁকান মাশরাফি। সেই ওভার থেকে ২৬ রান সংগ্রহ করেন তিনি। যা কোনো বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানের জন্য এক ওভারে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড। তাছাড়া টেস্ট, ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টিতে যথাক্রমে ৭৯৭, ১৪৯৫ ও ৩৬৬ রান করেছেন মাশরাফি।

ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই বহুবার ইনজুরির কাছে ধরাশয়ী হন মাশরাফি। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট খেলতে নেমে হাঁটুতে আঘাত পান তিনি। ফলে প্রায় দু'বছর মাঠের বাইরে নীরব দর্শক হয়ে থাকতে হয়েছিল মাশরাফিকে। এছাড়া ২০১১ সালে দেশের মাটিতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল বিশ্বকাপ। কিন্তু ঘরের মাঠে মাশরাফিকে বিশ্বকাপ খেলতে দেয়নি হাঁটুর চোট। সবমিলে দীর্ঘ ১৫ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে ৭ বার ইনজুরিতে পড়েছেন মাশরাফি বিন মর্তুজা। যেন ইনজুরিই তাঁর ‘চিরশত্রু’।

অধিনায়ক হিসেবেও দারুণ মাশরাফি। ২০০৯ সালে জুনে বাংলাদেশ দলের নেতৃত্ব পান মাশরাফি। তাঁর সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পান সাকিব আল হাসান। টানা সর্বোচ্চ সিরিজ জয়ী অধিনায়কের গৌরব অর্জন করেন মাশরাফি। তাঁর অধীনে ঘরের মাটিতে ভারত, পাকিস্তান, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো শক্তিশালী দলকে নাস্তানাবুদ করেই ক্ষান্ত হয়নি বাংলাদেশ। পাকিস্তানকে দিয়েছে হোয়াইটওয়াশের লজ্জাও। সর্বশেষ আফগানিস্তানের বিপক্ষেও সিরিজ জিতে বাংলাদেশ।

মাশরাফির পর এই তালিকায় আছেন ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপ জয়ী শ্রীলঙ্কা দলের অধিনায়ক অর্জুনা রানাতুঙ্গা। তার হাত ধরে ঘরের মাঠে শ্রীলংকা জিতেছে ৪টি ওয়ানডে সিরিজ। এছাড়াও ডাচ ওয়ানডে অধিনায়ক জেরোইন স্মিটসও ঘরের মাঠে রানাতুঙ্গার সমান টানা ৪টি ওয়ানডে সিরিজ জিতেছিলেন।

১৯৮৩ সালের ৫ অক্টোবর নড়াইলে তার নানাবাড়ীতে জন্মগ্রহণ করেন মাশরাফি। নানাবাড়ীতেই বেড়ে ওঠা মাশরাফির। তাঁর নানীর ধারণা-বিশ্বাস ছিল মাশরাফির মা সেসময় বাচ্চা-লালন পালনের উপযুক্ত না। আসলে বাবা-মার একমাত্র মেয়ে হওয়ায় সেসময় মাশরাফির মার যেন কোনো কষ্ট না হয়, সেজন্য মাশরাফিকে নিজের কাছেই রেখেছিলেন তাঁর নানী। মাশরাফির যখন ছয় মাস বয়স তখন তার পিতাকে চাকরি উপলক্ষে নড়াইল ছেড়ে সস্ত্রীক ঢাকায় এসে বসবাস করতে হয়। তিনি ছিলেন বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির কর্মাধ্যক্ষ। মাশরাফির বাবার নাম গোলাম মর্তুজা, তিনি বর্তমানে ব্যবসায়ী। আর মায়ের নাম হামিদা মর্তুজা, তিনি গৃহিনী।

মা-বাবা আদর করে কৌশিক নামে ডাকতেন মাশরাফিকে। ছোটবেলা থেকেই কৌশিক ছিল বেশ ডানপিটে। বাঁধাধরা পড়াশোনার পরিবর্তে ফুটবল আর ব্যাডমিন্টন খেলতেই বেশি পছন্দ করতেন তিনি। মাঝে মধ্যে বন্ধুদের নিয়ে চিত্রা নদীতে সাঁতার কাটা।এভাবেই নিজের দুরন্ত শৈশবটা কাটান মাশরাফি।

ব্যক্তিগত জীবনে বেশ হাসিখুশি আর উদারচেতা মানুষ মাশরাফি। 'নড়াইল এক্সপ্রেস' নামে অভিহিত মাশরাফির অন্যতম শখ বাইক নিয়ে ঘুরে বেড়ানো।নিজের শহরে বেশ জনপ্রিয় মুখ মাশরাফি। সেখানে তাঁকে ‘প্রিন্স অব হার্ট’ বলা হয়। শিক্ষাজীবন শুরু হয় নড়াইল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। নড়াইল সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০০১ সালে এসএসসি পাশ করেন। এইচএসসি পাশ করেন নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে ২০০৩ সালে। এরপর দর্শন শাস্ত্রে অনার্স কোর্সে ভর্তি হন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়ার সময় সুমনা হক সুমির সঙ্গে তার পরিচয় হয়। ২০০৬ সালে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তাঁরা। মাশরাফি ও সুমি দম্পত্তি বর্তমানে দুই সন্তানের জনক। সন্তান- মেয়ে: হুমায়রা মর্তুজা, ছেলে: সাহেল মর্তুজা।

টেস্ট ক্যারিয়ার ৩৬টি ম্যাচ খেলেছেন মাশরাফি। নিয়েছেন ৭৮টি উইকেট। গড় ৪১.৫২, ইকনোমি রেট ৩.২৪ করে। রান করেছেন ৭৯৭। ওয়ানডে খেলেছেন ১৬৬ ম্যাচ। উইকেট শিকার করেছেন ২১৬টি। সেরা বোলিং ফিগার ২৬ রানে ৬ উইকেট। রান করেছেন ১৪৯৫। আর টি-টুয়েন্টিতে ৪৯ ম্যাচ থেকে নিয়েছেন ৩৮টি। রান ৩৬৬।

এখনও লাল-সবুজের কাণ্ডারি মাশরাফি। তাঁর হাত ধরে আরও সামনে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ ক্রিকেট। আবারও উল্লাসে মাতবে এদেশের ক্রিকেট পাগল জনতা। উড়বে বিজয়ের কেতন। এমন প্রত্যাশা টাইগার প্রেমীদের।

(ঢাকাটাইমস/৮ নভেম্বর/জেইউএম)

সংবাদটি শেয়ার করুন

খেলাধুলা বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :