করোনা মোকাবেলা

অহং ছেড়ে বিশ্বনেতাদের কার্যকর প্লাটফর্ম জরুরি

এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার
 | প্রকাশিত : ০৯ জুলাই ২০২০, ১১:৩৮

করোনাভাইরাসের টিকা নিয়ে গবেষণা, টিকা তৈরি ও চিকিৎসায় বিশ্বনেতাদের সম্মিলিত উদ্যোগের প্রশংসা করেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক তেদরোস আধানোম গেব্রেয়াসুস। তবে তিনি বলেছেন, কত দ্রুত ও কত কার্যকর এ ব্যবস্থা করতে পারা যাবে, সেটা বিষয় নয়। বিষয় হলো, কতটা সুষমভাবে তা বণ্টন করা যাবে। সবাই সুরক্ষিত না হলে কেউই নিরাপদ নয়।

বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস মহামারি নিয়ে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধানের এই বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। অত্যন্ত সংক্রামক এই বৈশ্বিক মহামারি ঢুকে পড়ছে শহর-বন্দরের সুরক্ষিত অট্টালিকায়, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। ভাইরাস প্রতিরক্ষায় তাই বিশেষ কোনো শ্রেণি-গোষ্ঠী কিংবা অঞ্চলের সুরক্ষা নিশ্চিত করে স্থায়ীভাবে সংক্রমণ ঝুঁকি থেকে মুক্তির সুযোগ নেই। কোভিড-১৯ ইতিমধ্যে তা প্রমাণ করেছে।

চলমান সংকটে বিশ্বনেতাদের আত্মকেন্দ্রিক বৃত্তের বাইরে এসে উদারতার পরাকাষ্ঠা দেখানো অনিবার্য হয়ে পড়েছে। এই মুহূর্তে বিশ্বের প্রতিটি মানুষের জীবনের মূল্য কমপক্ষে তার নিজের জীবনের সমান কিংবা তারও বেশি এমন অনুভূতিকে স্পষ্ট করছে। করোনা সংকটকে বৈশ্বিক সংকট হিসেবে না দেখে কেউ যদি একা কিংবা তার দেশের মানুষের মুক্তির ভাবনায় পরিকল্পনা স্থির করে, কোনো সন্দেহ নাই সময়ের ব্যাপ্তিতে তা বুমেরাং হবে! কেবল রাজনীতিকে এক পাশে রেখে সত্যিকারের সহযোগিতার মাধ্যমেই পরিবর্তন সম্ভব।

অর্থাৎ করোনার সংক্রমণ-ক্ষ্মমতার ভয়াবহতার কথা মাথায় রেখে এখন সারা বিশ্বের মানুষের কথা একযোগে ভাবতে হবে। ধরুন, কোনো একটি নির্দিষ্ট সময়ে বিশ্বের সবাই একযোগে একটি ওষুধ সেবন করবে করোনা মোকাবেলা করার জন্য। এমন ক্ষেত্রেও যদি বিশ্বের কোনো একজন করোনা জীবাণুবাহক সেবাটি গ্রহণ না করে, তবে সেই একজনের কাছ থেকেই আবার পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে ভাইরাসটি।

কাজেই যেসব বিশ্বনেতা নিজেদের ভাবনায় এখনো বুঁদ হয়ে আছেন, তারা নিজেদের জীবনকেও অনিরাপদ করছেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বৈশ্বিক মহামারির বিরুদ্ধে খুব বেশি ক্রেডিট কিংবা বাহাদুরি করার মতো একক শক্তি যে কোনো দেশের নাই তা ইতোমধ্যে বিশ্ববাসী টের পেয়ে গেছে। কাজেই অর্থ-আস্ত্রের খোনকারগিরি বাদ দিয়ে যত দ্রুত সম্ভব বিশ্বনেতাদের একটি ভার্চুয়াল প্লাটফর্ম তৈরি করে তাতে একত্র হওয়া দরকার করোনা মোকাবিলায়।

কোভিড-১৯ মহামারির আশু সমাধানে বিশ্বমানবতার পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ গাইডলাইন তৈরি করতে হবে বিশ্বনেতাদের। যাদের গবেষণা করার মতো এক্সপার্ট আছে, তারা স্ব স্ব ক্ষেত্রে সেটি অব্যাহত রাখবে। সেই সাথে বিশ্বের সবার জন্য আলাদা একটি দৃশ্যমান প্ল্যাটফর্ম দাঁড় করানো জরুরি, যেখানে সব দেশের সমান অধিকার থাকবে।

এটি কোনোভাবেই ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে তৈরি হবে না। গবেষণা থেকে শুরু করে ভ্যাকসিন তৈরি, বণ্টন এবং এর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিতকরণ পর্যন্ত যাবতীয় কাজের ব্যবস্থাপনা করবে এই প্ল্যাটফর্ম। অবশ্যই বিনামূল্যে সব নাগরিক পাবে এই ভ্যাকসিন, তারও নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে।

গবেষণা ও ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত আর্থিক জোগান বিশ্বের সব দেশের সার্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে কোন দেশ কতটুকু কন্ট্রিবিউ্ট করবে তা নির্ধারণ করে দিতে হবে। যাদের সামর্থ্য কম বা সামর্থ্য নাই, তারাও যেন সমধিকার ভোগ করতে পারে সেটিও বিবেচনা করতে হবে। এ পর্যন্ত করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় বিশ্বের শতাধিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ভ্যাকসিন তৈরির চেষ্টা করছে, তাদের মধ্য থেকে অনেকে আমাদের জন্য আশার আলো বয়ে আনতে পারে। অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন এগিয়ে আছে বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

শোনা যাচ্ছে, চীন তাদের ভ্যাকসিনের চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে। তবে আপাতত দেশটির সেনাবাহিনীর গবেষণা শাখা এবং স্যানসিনো বায়োলজিকসের (৬১৮৫.এইচকে) তৈরি একটি কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন মানবশরীরে প্রয়োগের অনুমতি পেয়েছে। চীনের সেন্ট্রাল মিলিটারি কমিশন এডি৫-এনকোভ ভ্যাকসিনটি সৈন্যদের দেহে এক বছরের জন্য প্রয়োগের অনুমোদন দিয়েছে। স্যানসিনো বায়োলজিকস এবং একাডেমি অব মিলিটারির একটি গবেষণা ইনস্টিটিউট যৌথভাবে ভ্যাকসিনটি তৈরি করেছে।

বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলেছে, ভ্যাকসিনটি চীনের বাইরেও পরীক্ষামূলক প্রয়োগ হচ্ছে। ইতিমধ্যে কানাডায় পরীক্ষামূলক প্রয়োগের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। তবে চীনের লজিস্টিক সাপোর্ট বিভাগের অনুমোদনের আগে এটি ব্যাপকভাবে সাধারণ মানুষের শরীরে প্রয়োগ করা হবে না। আমরা আশা রাখছি, পরীক্ষামূলক হলেও প্রতিটা রাষ্ট্রের মানুষের দেহে এর প্রয়োগ করে দ্রত ফলাফল নিশ্চিত করা দরকার। কারণ সব দেশের মানুষের রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা সমান নয়।

এই মুহূর্তে বিশ্বনেতাদের সামগ্রিক ভাবনার বড়ই প্রয়োজন। এরই মধ্যে পাঁচ লাখের বেশি প্রাণ ঝরেছে করোনাভাইরাসে। বিশ্ব অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষাক্ষেত্র পিছিয়ে গেছে অনেক দূর। যত দেরিতে গিয়ে উপলব্ধি হবে, ততদিনে আরও অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিশ্ব। তত বেশি আলিঙ্গন করতে হবে দুঃখকে। অনেক অনেক বেশি প্রাণহানি ঘটবে দেশে দেশে। আর বেঁচে থাকা মানুষের বড় একটা অংশ হয়তো মানসিকভাবে ভারসাম্য হারাবে।

এভাবে চলতে থাকলে আশঙ্কা তৈরি হওয়া স্বাভাবিক যে, বিশেষ করে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, শিক্ষাব্যবস্থা, বাজার অর্থনীতি, গগনচুম্বী বেকারত্ব, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটবে। আর দুর্ভিক্ষের আকার হবে এতটাই ভয়ানক যা পৃথিবী আগে কখনোই পরখ করেনি! সেই সাথে রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্বন্দ্ব শুরু হবে, মানুষে মানুষে বাড়বে অবিশ্বাস। এর পরিণতি এমন চরম পর্যায়ে পৌঁছাবে যে রাষ্ট্র বা সমাজের কোনো স্তরেই হয়তো চলমান নেতৃত্ব দিয়ে সেটি সমাধান করা সম্ভব হবে না।

পরিশেষে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, জি২০ দেশগুলো বিষয়সংশ্লিষ্ট ভিডিও কনফারেন্স করলেও যেসব দেশ জিডিপির আশি শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে তাদের উদাসীনতা কিংবা কাঙ্ক্ষিত আগ্রহ পরিলক্ষিত না হওয়ার বিষয়টিও উদ্বেগজনক। দ্রুততম সময়ের মধ্যে একটি সাধারণ প্লাটফর্ম যদি আশার আলো না জাগায় কিংবা কার্যকর না হয় তবে আজকের একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক সভ্যতার অহংকার রীতিমতো অসভ্যতার চিত্রে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা অমূলক হবে না।

আশা করি বিশ্বনেতারা এবার গা ঝাড়া দেবেন। কিন্তু মনে রাখা জরুরি, বিশেষ করে শুধু বাজারজাত করে পয়সা কামানোর মতো হীনমানসিকতার কারণে যেন সব সফলতা বিফলে না যায়।

লেখকঃ পুলিশ সুপার। গীতিকবি, প্রাবন্ধিক ও কণ্ঠশিল্পী

(ঢাকাটাইমস/৯জুলাই/মোআ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :