বদলে যাওয়া পুলিশ ও একটি বিশ্ববিদ্যালয়

মোহাম্মাদ আনিসুর রহমান
  প্রকাশিত : ০৮ জুলাই ২০২১, ১৩:২৪| আপডেট : ০৮ জুলাই ২০২১, ১৩:২৬
অ- অ+

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ পুলিশের অনেক কাজ সমাজবান্ধব হওয়ায় সমাজ গবেষক হিসেবে বিষয়গুলোর প্রতি এক ধরণের মমত্ববোধ থেকেই আজকের এই লেখার অবতারণা। বাংলাদেশ পুলিশের মাধ্যমে ৯৯৯ জরুরি সেবা প্রদানের মহৎ কাজ, কমিউনিটি পুলিশিং, বিট পুলিশিং, স্বাভাবিক সময় ও করোনাকালে বুক পেতে দিয়ে সমাজ সেবা এবং মানবিক সহায়তা, সাধারণ ডায়েরি (জিডি) ও পুলিশ ভেরিফিকেশন ভীতি দূর করা, পুলিশে চাকরি করে বেদে, যৌনপল্লীতে জন্ম নেয়া শিশু-কিশোর ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের পাশে দেবদূত হয়ে দাঁড়ানোর দৃশ্যপট বাংলাদেশ পুলিশে এখন নিত্য-নৈমিত্তিক বিষয়। ভাবতে ভালো লাগে যে, দশ বছর আগের পুলিশি সেবা আর বর্তমানের পুলিশি সেবার মধ্যে রয়েছে আকাশ-পাতাল ইতিবাচক ব্যবধান।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সম্মুখ সমরে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তোলা ও আত্মত্যাগের প্রতিদানে ‘স্বাধীনতা পদকে’ ভূষিত হওয়া প্রায় দুই লক্ষ সদস্যের তেজদীপ্ত বাহিনী বাংলাদেশ পুলিশ এখন এক আস্থার নাম।

দুই. জাতীয় জরুরি সেবার হটলাইন নম্বর ৯৯৯ যা তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ রূপকল্পের অংশ হিসেবে ১২ ডিসেম্বর, ২০১৭ সালে চালু হয়। ৯৯৯ বাংলাদেশ পুলিশের অধীনে পরিচালিত একটি জরুরি সেবা প্রদানের কল সেন্টার। বাংলাদেশের নাগরিক কিংবা বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশি পর্যটক সম্পূর্ণ টোল ফ্রি কলের মাধ্যমে বাংলাদেশের যে কোনো ফোন বা মোবাইল নম্বর থেকে ২৪ ঘণ্টা জরুরি প্রয়োজনে যেমন, গহীন অরণ্যে কিংবা গভীর সমুদ্রে পথ হারানো, উঁচু দালানে আটকে পড়া পাখী বা বিভিন্ন প্রাণী উদ্ধার, গৃহকর্মী নির্যাতন, পারিবারিক কলহ, বাল্যবিবাহ রোধ, সাইবার অপরাধের শিকার, সড়ক-নৌ দুর্ঘটনায় সহায়তা, এসিড নিক্ষেপ, দুর্বৃত্ত পুরুষ আক্রান্ত নারী, আগুন লাগা, প্রভাবশালীদের লোভের শিকার প্রাচীন ঐতিহ্য উদ্ধার, ডাকাতি ও ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধরনের সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে, অ্যাম্বুলেন্স ও ফায়ার সার্ভিস সহায়তার জন্য মানুষ ৯৯৯-এ ফোন করে প্রয়োজনীয় এবং জরুরি সেবা নিয়মিত এবং দ্রুত পাচ্ছে। যার কারণে ৯৯৯ বর্তমানে অসহায় কিংবা সাহায্য প্রার্থী মানুষের কাছে এক আস্থা ও বিশ্বস্ত সহচর হিসাবে আর্বিভুত হয়েছে।

তিন. বাংলাদেশ পুলিশের বর্তমান চৌকস ও মেধাবী মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদের প্রবর্তিত ব্যবস্থা বিট পুলিশিং, যার শ্লোগান হলো ‘আপনার পুলিশ আপনার পাশে, তথ্য দিন সেবা নিন’ এবং ‘বিট পুলিশিং বাড়ি বাড়ি, নিরাপদ সমাজ গড়ি’। বিট পুলিশিং এর মাধ্যমে প্রতিটি থানার দূরবর্তী তৃণমূল অঞ্চলে পুলিশের উপস্থিতি নিয়মিত করা এবং পুলিশি সেবা নিশ্চিত পৌঁছে দেয়া সম্ভব হলে পুলিশ ও রাষ্ট্রের নাগরিকদের মধ্যে পুলিশ ভীতি ও দূরত্ব এবং অপরাধ হ্রাস পেয়ে অপরাধীর দৌরাত্মও কমে একটি ‘কমিউনিটি’র সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য মাইলফলক হতে পারে।

বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক বুদ্ধিদীপ্ত মহাপরিদর্শক (আইজিপি) জনাব এ কে এম শহীদুল হক বাংলাদেশে কমিউনিটি পুলিশিং এর অন্যতম প্রবর্তক ও উদ্যোক্তা। ‘পুলিশই জনতা-জনতাই পুলিশ’- স্লোগানকে সামনে রেখে বাংলাদেশ পুলিশের কমিউনিটি পুলিশিং অপরাধ দমনের কৌশল হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। কমিউনিটি পুলিশিং হল একটি কৌশল যা কমিউনিটির সদস্যদের সাথে পুলিশ সদস্যদের নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলার দিকে, সমস্যা চিহ্নিতকরণ, প্রতিরোধমূলক ও অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে সমাধানের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। গণমুখী পুলিশিং এর অংশ হিসেবে ১৮২৮ সালে আধুনিক পুলিশের জনক বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী (১৮৩৪-৩৫; ১৮৪১-৪৬) রবার্ট পিল (১৭৮৮-১৮৫০) প্রথম কমিউনিটি পুলিশিং ও বিট পুলিশিং এর ধারণা প্রবর্তন করেন।

চার. বাংলাদেশ পুলিশের একজন দক্ষ, মেধাবী ও রোল মডেল ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা ঢাকা রেঞ্জের বর্তমান ডিআইজি হাবিবুর রহমান। বর্তমানে তিনি সুবিধাবঞ্চিত ও প্রান্তিক বেদে জনগোষ্ঠী, যৌনপল্লীর শিশু-কিশোর এবং তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের কাছে এক মহান মানুষ ও দেবদূত। গত বছর করোনাকালে মানুষের পাশে ২৪ ঘণ্টা থাকার জন্য লকডাউন সময়ের রোজার ঈদের আগে তিনি ৩৮ দিন বাসায় যাননি। হাবিবুর রহমান করোনায় আক্রান্ত পুলিশ সদস্য, পরিচিতজন ও সহায়তা চেয়েছেন এমন সব শ্রেণি-পেশার মানুষের পাশে তাঁর সর্বোচ্চ দিয়ে যেমন পাশে দাঁড়িয়েছেন, ঠিক তেমনি ত্রাণ পৌঁছে দিয়েছেন দেশের প্রত্যন্ত পটুয়াখালির চরমোন্তাজ পর্যন্ত। হাবিবুর রহমান রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য একজন নিবেদিতপ্রাণ কর্মীর নাম যিনি রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে প্রতিষ্ঠিত করেছেন বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। পুলিশ সদস্যসহ সকলের জরুরি প্রয়োজনের জন্য পুলিশ হাসপাতালে প্রতিষ্ঠিত করেছেন ব্লাড ব্যাংক। সব শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য ব্লাড ব্যাংক থেকে করোনাসংক্রমণের দিনগুলোতে প্রয়োজনীয় প্লাজমা সংগ্রহের মানবিক ব্যবস্থা করেছেন। তাঁর রেঞ্জের অধীনে ‘ডিজিটাল রিমোট মনিটরিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’ চালুর মাধ্যমে ১৩টি জেলার ৯৬টি থানার ডিউটি অফিসারের কক্ষ, হাজতখানা এবং সেন্ট্রিবক্স রেঞ্জ অফিসে বসেই পর্যবেক্ষণ, ‘অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা এবং দায়িত্বে অবহেলা’ সংক্রান্ত নানা অভিযোগ কঠোর মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করেছেন। জনাব হাবিবুর রহমান ‘বেস্ট প্র্যাকটিস’ নামক ‘পুলিশি পরিষেবা হয়রানিমুক্ত ও জনবান্ধব’ এক কৌশলের উদ্ভাবক যার মাধ্যমে থানায় জিডি, পুলিশ ক্লিয়ারেন্স, নারী নির্যাতনরোধ, মামলা, তদন্ত নিষ্পত্তি, গ্রেপ্তার বা রিমান্ডের আসামি, পাসপোর্ট ভেরিফিকেশন সম্বলিত সার্বিক দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

পাঁচ. ডোবা বা নালায় পড়ে থাকা শিশু উদ্ধার ও আগুনে পোড়া ভবনে প্রবেশ করে জান-মালের ক্ষয়-ক্ষতির প্রশমন করার মানবিক কাজ করছে পুলিশ। করোনায় মৃত ব্যক্তির গোসল, কাফন-দাফনেও পুলিশ এগিয়ে এসেছে অনায়াসে-অবলীলায়। করোনা সংক্রমণের দিনগুলোতে করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির সহায়তায় পুলিশ এগিয়ে এসে এবং ওষুধ-খাবারসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী পৌঁছে দিয়ে মানবিকতার এক ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের কর্মযজ্ঞ অবলোকন করেছে গোটা দেশবাসী। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের জনাব শওকতের নামের আগে ‘মানবিক’ বিশেষণ জুড়ে দিয়েছেন নেটিজেনরা। অনেক কষ্টের বিষয় হলো এমন সব মানবিক ও মহৎ কাজ অনেক সময় ঢেকে যায় কতিপয় অনৈতিক, অমানবিক এবং দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিশ সদস্যের কারণে। ব্যক্তির দায় বাহিনীর নয় আমরা বুঝি। কিন্তু কতিপয় অসৎ কোনো পুলিশ সদস্যের কারণে গোটা বাহিনীর সুনাম নষ্ট হতে ‍দিলে তা পুলিশের জন্যই আত্মঘাতী হবে।

ছয়. রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় দুই লক্ষ সদস্যের এক সুগঠিত বাহিনীর নাম বাংলাদেশ পুলিশ। রাষ্ট্র ও জাতির জন্য বর্তমান মানবিক পু্লিশকে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় উপহার দিয়ে সরকার মানবতা এবং উদারতার পরিচয় দিতে পারে। বদলিযোগ্য চাকরির অধিকাংশ সময় পরিবারের বাইরে থাকায় দুই লক্ষাধিক পরিবারের সদস্য ও সন্তানদের অভিভাবক হওয়ার এক দারুণ সুযোগ সরকারের সামনে। কারণ রাষ্ট্র ও অফিসিয়াল দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেক পুলিশ সদস্য নিজ পরিবারের ও ছোটো ভাই-বোন কিংবা সন্তানের লেখাপড়ার দেখভাল করতে পারেন না। আর তাই পারিবারিক ও আর্থিক সক্ষমতা নিয়ে কেউ উচ্চশিক্ষা লাভ করতে পারে আর অনেকেই পারে না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছোটো ভাই-বোন কিংবা সন্তানকে পড়ানোর সঙ্গতি অধিকাংশ পুলিশ সদস্যের নেই। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, করোনাযোদ্ধা পুলিশসহ দেশের অতন্দ্র প্রহরী সকল বাহিনীর পরিবারের পাশে সরকার সব সময় অভিভাবক হিসাবে পরিপূর্ণ দায়িত্ব পালন করবে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ নৌবাহিনী, বাংলাদেশ বিমানবাহিনী, বাংলাদেশ পুলিশ ও বর্ডার গার্ড অব বাংলাদেশ (বিজিবি) গত কয়েক দশকের প্রচেষ্টা ও্ জাতিসংঘের মিশনে শান্তিরক্ষার প্রতিদানে আন্তর্জাতিক মানের বাহিনী হিসাবে বিশ্বে স্বীকৃতি পেয়েছে। চীনের যে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি পড়ি সেখানে দক্ষিণ সুদান, সিয়েরা লিয়ন, মালি, কঙ্গো, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, লেবাননসহ জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ কাজ করেছে এমন বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশি শিক্ষার্থী দেখলে ‘মাই ফ্রেন্ড’-‘আওর ফ্রেন্ড’ বলে আনন্দে আত্মহারা ও আপ্লুত হয়ে ওঠে। জাতি হিসাবে এটি অনেক বড় সম্মানের এবং গৌরবের।

লেখক: পিএইচডি গবেষক, আন্তজাতিক সম্পর্ক ও বৈশ্বিক সুশাসন, ঝেজিয়াং ইউনিভার্সিটি, চীন।

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
সাংবাদিকদের মিলনমেলায় রঙিন ছিল ডিএসইসির ফ্যামিলি ডে
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন কিছুই চাপিয়ে দিচ্ছে না: আলী রীয়াজ
পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎসংযোগ নিশ্চিতে একসঙ্গে কাজ করবে ইডটকো বাংলাদেশ ও টাইগার নিউ এনার্জি
টাঙ্গাইলে বাস-অটোরিকশার সংঘর্ষে নিহত ৩
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা