কাওসার আহমেদ চৌধুরী বললেন, আপনি তো আমার সংসারে আগুন লাগিয়ে দেবেন!

শাহান সাহাবুদ্দিন
| আপডেট : ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৪:৪৩ | প্রকাশিত : ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৪:৩৩

কাওসার আহমেদ চৌধুরীর সঙ্গে আমার পরিচয় ২০১১ সালের অমর একুশে বইমেলায়। সে বছরটি আমাকে দিয়েছে অনেক৷ কেড়েও নিয়েছে। চিরকাল প্রচারের বাইরে থাকা পছন্দ আমার। অন্তত আমার সৃষ্টিশীলসত্তা এটিই পছন্দ করে।

নিজের লেখালেখি নিয়ে, নিজের বই নিয়ে সাধারণত আমি কোথাও যেচে আলাপ করতে যেমন পছন্দ করি না। তেমনি বইমেলায় প্রকাশিত নিজের বই নিয়েও কাউকে কিছু বলা, মিডিয়ার আলোয় থাকা। এগুলোও ভালো লাগে না।

অথচ এই আমি ২০১১ সালের বইমেলায় রেকর্ডসংখ্যক উপস্থিত ছিলাম। প্রায় ২২ দিনের মতো। সে বছরই রোদেলা প্রকাশনী থেকে আমার প্রথম বই 'আত্মহত্যার আগে' বেরোয়। কী কারণে জানিনা বইটির প্রথম মুদ্রণ শেষ হয়ে যায় মেলার মাঝামাঝি সময়ে। হয়তো নামকরণের কারণে। নামটি টেনে থাকবে পাঠককে।

অন্যদিকে আমাদের গর্বেরধন কথাশিল্পী স্বকৃত নোমান ভাইয়েরও ছিল অসামান্য ভূমিকা। প্রকাশক রিয়াজ ভাইও ছিলেন বইটির ব্যাপারে আন্তরিক। পত্র-পত্রিকা,টেলিভিশনে এ নিয়ে তিনি কথা বলেছিলেন। বইটির অসাধারণ প্রচ্ছদ করেছিলেন প্রতিভাধর চিত্রশিল্পী মাহবুব কামরান ভাই। তিনি অকাল প্রয়াত হন। মাহবুব ভাইয়ের মৃত্যু আমাকে কষ্ট দিয়েছিল।

সে বইমেলার এক সন্ধ্যায় জাকির তালুকদার, চঞ্চল আশরাফ,স্বকৃত নোমান ভাই, আব্দুল্লাহ আল হারুন মামা, রিয়াজ ভাই ও আরও কেউ কেউ সহ আমরা আড্ডা দিচ্ছিলাম নজরুল মঞ্চের কাছকাছি রোদেলার স্টলের সামনে। সেখানেই আকস্মিক এলেন কাওসার আহমেদ চৌধুরী। তাঁর সঙ্গে আমাকে কে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন মনে করতে পারছি না। সম্ভবত রিয়াজ ভাই।

যদিও অধিকাংশ খ্যাতিমান লোকদের সঙ্গে তখন আমার সখ্যতা করিয়ে দিতেন নোমান ভাই। কাওসার ভাইয়ের সঙ্গে তাঁর স্ত্রী ছিলেন। ভাবী কী ভেবে বলে বসলেন, শাহান,আপনার সঙ্গে কোথাও আমার এর আগে দেখা হয়েছে। আমি নিশ্চিত। আপনাকে আমার অনেক পরিচিত মনে হচ্ছে। কোথায় দেখা হয়েছে বলুন তো!

আমি নির্বিকার। কেননা এ প্রশ্নের উত্তর জানা ছিল না। আদতে ভাবীর সঙ্গে আমার কোথাও দেখা হয় নি।

ভাবী ফের বললেন,আপনার বাসা কোথায়?

-গাজীপুর।

-ও,ঠিকই আমি আপনাকে চিনতে পেরেছি। আপনাকে আমি ধান গবেষণায় দেখেছি।

আমি চুপচাপ। স্মিত হাসছি। কেননা আমার স্মৃতিতে কিছুই নেই।

এইক্ষণে কাওসার আহমেদ চৌধুরী বললেন,শাহান, আপনি তো আমার সংসারে আগুন লাগাবেন দেখছি! এ বুড়ো বয়সে এমনটি হবে জানলে তো আজ বইমেলায় আসতাম না। এলেও এদিকে আসতাম না। কেন যে আজ নিজের হাত নিজে দেখিনি! বলেই দমক দমক হাসিতে বইমেলা কাঁপাতে থাকলেন। তাঁতের শাড়ি, কপালে চাঁদের মতো গোলাকার পিঙ্ক রঙা টিপে স্বাস্থ্যবতী উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের ভাবী এবার কাওসার ভাইকে বললেন, তুমি না...!

আমরা সবাই হাসছি।

তার অল্পপরই পাশ দিয়ে পুলিশ-পরিবেষ্টিত হেঁটে যাচ্ছিলেন সেসময়ের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সাহেব। কাওসার ভাইকে দেখেই বললেন,আরে তুমি,কতোদিন দেখা নেই!

সিলেটি ভাষায় কাওসার ভাই যা উত্তর করলেন তার মানেটা দাঁড়ায় এই-

এখন আর কেন দেখা হবে মুহিত ভাই! এখন তো আপনার সুদিন! জ্যোতিষী কাওসারকে দরকার পড়বে ক্ষমতা চলে গেলে!

দুজনেই মৃদু হাসতে থাকলেন। আউল বাউল হাওরের মানুষ দুজনেই। ভৌগোলিক কারণেই হতে পারে তাঁরা রসিক ও দিলখোলা।

এই ছিলেন কাওসার আহমেদ চৌধুরী।

এমন প্রবল রসবোধসম্পন্ন মানুষ অল্পই দেখেছি। তাঁর সঙ্গে রসবোধে যায় আরেকজন আছেন। নির্মলেন্দু গুণ।

খ্যাতিমান মানুষটি লোকচক্ষুর আড়ালে থাকতে পছন্দ করতেন। কখনো পুরস্কারের পিছনে ছুটেন নি। কাজ করে গেছেন। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেছিলেন তিনি।

তাঁর রসবোধের সঙ্গে লাখো মানুষ পরিচিত প্রথম আলোর সাপ্তাহিক ক্রোড়পত্র 'ছুটির দিনে' 'আপনার রাশি' পাঠের মাধ্যমে। জ্যোতিষশাস্ত্রের জটিল বিষয়টি এতো সহজ করে উপস্থাপন করতেন! এসবে প্রবল হিউমার যোগ করতেন। আত্মবিশ্বাস তৈরিতেও তাঁর রাশিফল ভূমিকা রাখতো। এবং তিনি বলতেন, মানুষ নিজের চেষ্টায় ৯০-৯৬ ভাগ ভাগ্য গড়তে পারেন। বাকিটা নিয়তি। অথচ তিনি প্রথাগত জ্যোতিষী ছিলেন না।

কাওসার ভাইকে আমার ভালো লেগে যায়। ভাবীকেও। তাঁদেরকে আমার 'আত্মহত্যার আগে' বইটি উপহার দিই। কাওসার ভাইও জ্যোতিষ শাস্ত্রের ওপর লেখা তাঁর একটি বই আমাকে অটোগ্রাফসহ উপহার দেন। অটোগ্রাফে চমৎকার কিছু কথা লিখেছিলেন। দুর্ভাগ্য,আমার ছোটচাচা জসিম উদ্দিন সাহেব বইটি পড়তে নিয়ে আর ফেরত দেননি। সম্ভবত হারিয়ে ফেলেছেন। কাওসার ভাইয়ের হাতের লেখাও ছিল অসাধারণ। হয়তো চারুকলার ছাত্র ছিলেন বলে।

বলতে দ্বিধা নেই, তখনো জানতাম না তিনি কতোবড় গীতিকবি। অধিকাংশ গীতিকবির ললাটে যা লেখা থাকে। পাদপ্রদীপের বাইরে থাকা। কাওসার ভাই তাঁর ব্যাগ থেকে বের করে কম্পোজ করা ক’টি পাতা দিলেন। উপহার। তাঁরই লেখা গানের তালিকা। প্রথম পঙক্তি উল্লেখসহ। যতো পড়তে থাকি ততোই বিস্মিত হতে থাকি। আমি কী নির্বোধ, তাঁকে কিনা জানতাম স্রেফ হস্তরেখা বিশারদ হিসেবে!

অথচ নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী, লাকী আখান্দ, সামিনা চৌধুরী, কুমার বিশ্বজিৎ ও আইয়ুব বাচ্চু প্রমুখের কন্ঠে তাঁর গানের হিরণ্ময় পঙক্তি কতোইনা ভাসিয়েছে বসন্তের অজুত নিযুত রাত্রিদিন! এখনো ভাসায়। বিপুলসংখ্যক জনপ্রিয় গান তিনি লিখেছেন। জানলাম। জানলাম, বিপুলা কালজয়ী গানের গীতিকার তিনি।

কতোরাতদিন নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরীর ধ্রুপদী গায়কীতে চোখে শ্রাবণ নেমেছে যখন শুনেছি---

আজ এই বৃষ্টির কান্না দেখে মনে পড়লো তোমায়

অশ্রু ভরা দুটি চোখ

তুমি ব্যথার কাজল মেখে লুকিয়েছিলে ঐ মুখ ...

কিংবা বসন্তের আগুনলাল বিকেলে পাগলপারা হয়েছি যখন কুমার বিশ্বজিৎের কন্ঠে শুনেছি--

যেখানে সীমান্ত তোমার, সেখানে বসন্ত আমার...

অথবা আমার একসময়ের ক্রেজ লাকী আখান্দের স্বর্ণাভ সুর ও কন্ঠে--

আমায় ডেকো না ফেরানো যাবে না

ফেরারি পাখিরা কুলায় ফেরে না...

বা, লাখো মানুষকে ঘোরগ্রস্ত ক'রে রাখা প্রয়াত রকস্টার আইয়ুব বাচ্চুর ভরাট কন্ঠে--

এই রুপালি গিটার ফেলে একদিন চলে যাবো দূরে বহুদূরে...

কিন্নরী কন্ঠের সামিনা চৌধুরীর অদ্ভুত গায়কীতে যখন আমরা শুনলাম 'কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে রাতের নির্জনে'...

তখন কী আমরা শ্বাশত প্রেমের উদ্যানে আমাদের যৌবনের নান্দনিক আগুন ও রোমান্টিসিজমের শিল্পীত সু্বিশাল আকাশ আবিষ্কার ক'রে নিজেদেরকে অন্যরকম মানুষ হিসেবে জেনে অভিভূত হই নি!

এরকম আরও কতো বিপুল কালজয়ী গানের স্রষ্টা তিনি!

২০১২ সালে আমার জীবনে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। মানসিকঅন্ধকারের জলপাইবনে লাল নীল হরিদ্রা বর্ণের পাতা ঝরতে থাকে, পড়তে থাকে। আমি হারিয়ে যেতে থাকি জীবনানন্দের ধূসর মর্বিড আকাশে। আমাকে সারিয়ে তুলতে বিশাল হৃদয় ও উজ্জ্বল হাত নিয়ে পাশে দাঁড়ান ড. রুহুল ফোরকান সিদ্দিকী, ড. মোহিত কামাল, ড. শাহিদা চৌধুরী মুন্নী, ড. জহির উদ্দিন আহমেদ প্রমুখ মান্যবর, এবং স্বকৃত নোমান ভাই, নাজু ভাবীর মতো আরও কেউ কেউ। তাঁরা আমার নমস্য।

সেইদিনগুলোতে একবার ভাবলাম একটু ভিন্নপথে হাঁটি। কেননা আমি ঘুরে দাঁড়াতে চাইলাম, এবং টিকে থাকার লড়াই জারি রাখতে চাইলাম। ফোন দিলাম কাওসার ভাইকে। বললাম, ভাই, আসতে চাই।

-আরে শাহান, আপনি! আপনি না এলে কে আসবে!

-আড্ডা দিতে নয়। আমি বিপন্ন। আপনাকে দরকার। মৌলিক দরকার।

বললেন, এরকম বুদ্ধিদীপ্ত, চিরচঞ্চলা যুবক থেকে আমি এরকমটি আশা করিনি। আসুন, চলে আসুন, আপনার জরিমানা করব!

আহা, সেই ভালোবাসার মানুষটি আর নেই! নিভৃতচারী বিপুলবিস্ময় আর নেই। চলে গেলেন। আকাশের ওপারে আকাশ হলেন। তাঁকে ডেকেও আর ফেরানো যাবে না। কেননা ফেরারি পাখিরা কুলায় ফেরে না!

লেখক: কবি, লেখক ও সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফেসবুক কর্নার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :