বিদ্যুতের জন্য বিদেশ থেকে আসছে জ্বালানি

চাহিদা অনুসারে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পর্যাপ্ত জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট সব সংস্থাকে নির্দেশনা দিয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়। আসন্ন গ্রীষ্মে শিল্পকারখানাসহ দেশে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহে প্রতিদিন ১২০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করতে হবে। বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য গ্যাসের সরবরাহ ৯০ কোটি ঘনফুটের কম হওয়ায় লোডশেডিং ভোগান্তিসহ শিল্পকারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।

এ অবস্থায় গ্রীষ্মকালে আসন্ন সংকট মোকাবিলায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ২৪০০০ মিলিয়ন ঘটফুট (৮ কার্গো) তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) সংগ্রহের জন্য বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে।

সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত মোট ১২ কার্গো এলএনজি সংগ্রহের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৮ কার্গো গ্যাস বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে লাগানোর চিন্তা করছে সরকার।

অন্যদিকে, এক মাস পরেই উৎপাদনে যাচ্ছে কয়লাভিত্তিক চট্টগ্রামের বাঁশখালি বিদ্যুৎ কেন্দ্র। গ্রীষ্মে বিদ্যুৎ সংকট মোকাবিলায় এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ওপরও ভরসা করছে সরকার। আর ভারতের আদানি গ্রুপ থেকে আমদানির প্রায় ১৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সংকটকালে আগেই দেশে আসছে বলে আশা করছে বিদ্যুৎ বিভাগ।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র বলছে, গ্রীষ্মে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়তে পারে আরও ছয় হাজার মেগাওয়াট। এই চাহিদা মেটাতে সরকার সব চেয়ে বেশি কাজে লাগাতে চায় গ্যাস-কয়লা ও ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে।

এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ইজাজ আহমেদ ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘সংকটের সময়ে এলএনজি আমদানি একটি ভালো সিদ্ধান্ত। এ গ্যাস আনা না হলে কিছুদিনের মধ্যে গ্যাসের সংকট চরম আকার ধারণ করত। তবে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকারকে গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে কয়লার ওপর জোর দিতে হবে। না হলে আমদানিকৃত গ্যাসের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত না হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাবে।’

পেট্রোবাংলা জানায়, স্পট মার্কেট থেকে ৮ কার্গো তরলিকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস এলএনজি আমদানি করা হবে, যা দিয়ে গ্রীষ্মের চাহিদা মেটানো হবে। প্রতি কার্গোতে ৩০০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস থাকে।

এলএনজি আমদানির বিষয়ে রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানির (আরপিজিসিএল) এলএনজি ডিভিশনের মহাব্যবস্থাপক ইঞ্জিনিয়ার শাহ আলম ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘স্পট মার্কেট থেকে কেনা ৬০ মেট্রিক টন এলএনজি (৩০০০ মিলিয়ন ঘনফুট) ইতোমধ্যেই দেশে এসেছে। আরও ১০ থেকে ১২ কার্গো গ্যাস আমদানি করা হবে। গ্যাসের মূল্য যদি স্বাভাবিক থাকে তাহলে কার্গো আমদানির পরিমাণ সামনে বাড়ানো হবে।’

তিনি বলেন, ‘স্পট মার্কেট থেকে কেনা এলএনজি নিয়ে আসা জাহাজ থেকে গত বৃহস্পতিবার এলএনজি আনলোড শেষ হয়। যা দিয়ে জাতীয় গ্রিডে ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস যুক্ত হয়। এতে গ্যাসের সরবরাহ আগের চেয়ে বেড়েছে। একই সঙ্গে শিল্প কারখানায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের সরবরাহ কিছুটা হলেও বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়েছে।’

রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি (আরপিজিসিএল) সূত্র জানিয়েছে, তিন হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস নিয়ে প্রথম কার্গো পৌঁছেছে, যা থেকে প্রতিদিন ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা যাবে।

সূত্র জানায়, গত ১৯ ফেব্রুয়ারি সঞ্চালন লাইনে এলএনজি সরবরাহ হয়েছে ৪৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট, ২০ ফেব্রুয়ারিতে ৪৯০, ২১ ফেব্রুয়ারি ৫২৯ এবং ২২ ফেব্রুয়ারি তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৪৭ মিলিয়ন ঘনফুট।

আরপিজিসিএল-এর এলএনজি ডিভিশনের মহাব্যবস্থাপক ইঞ্জিনিয়ার শাহ আলম আরও জানান, স্পট মার্কেট থেকে আরেকটি কার্গো আসবে ১১ মার্চ। অন্য কার্গোগুলো আসার শিডিউল এখনও ঠিক হয়নি।

দেশে আসা ওই এলএনজি আমদানির ব্যয় ৬৯০ কোটি ৪২ লাখ ৯ হাজার ৩১২ টাকা। আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম বৃদ্ধির পর দীর্ঘদিন এলএনজি আমদানি বন্ধ ছিল।

জানা গেছে, দেশের বিদ্যমান ও ক্রমবর্ধমান গ্যাসের চাহিদা পূরণের জন্য রাস লাফফান লিকুইডিফাইড ন্যাচারাল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (কাতারগ্যাস) এবং ওমান ট্রেডিং ইন্টারন্যাশনাল (বর্তমান নাম ওকিউটি)-এর সঙ্গে দুটি দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির মাধ্যমে এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। স্পট মার্কেট থেকে এলএনজির দাম স্বাভাবিক মূল্যের চেয়ে বহুগুণে বৃদ্ধি পাওয়ায় ২০২২ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি কার্যক্রম বন্ধ ছিল।

সূত্র জানায়, চাহিদার তুলনায় গ্যাসের সরবরাহ কম থাকায় বিশেষ করে বিদ্যুৎ উৎপাদন, ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ ও শিল্প খাতে স্বাভাবিক গ্যাস সরবরাহে বিঘ্ন ঘটে। গ্যাসের ঘাটতির ফলে শিল্প খাতে উৎপাদন ব্যাহত বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের পক্ষ থেকে গ্যাস সরবরাহে বিঘ্ন ঘটে। গ্যাসের ঘাটতির ফলে শিল্প খাতে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের পক্ষ থেকে গ্যাস সরবরাহ নির্বিঘ্ন করতে এবং গ্যাসের ঊর্ধ্বমূল্য বিবেচনায় প্রয়োজনে বর্ধিত মূল্যে হলেও গ্যাস সরবরাহের জন্য অনুরোধ করা হয়।

এ অবস্থায় স্পট মার্কেট থেকে উচ্চমূল্য বিবেচনায় নিয়ে গত ১৮ জানুয়ারি এসআরও নং-১৪ আইন/২০২৩ অনুয়ায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত গ্যাসের মূল্য ১৪ টাকা ঘনমিটার, ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ ও শিল্পে ব্যবহৃত গ্যাসের মূল্য ৩০ টাকা ঘনমিটার নির্ধারণ করা হয় যা ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর হয়েছে। সে লক্ষ্যে দেশে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের জন্য স্পট মার্কেট থেকে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত সর্বমোট ১২ কার্গো এলএনজি সংগ্রহের জন্য বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদমন্ত্রী নীতিগত অনুমোদন দিয়েছেন।

এদিকে এলএনজি আমদানিকে ইতিবাচক উদ্যোগ হিসেবে মনে করছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। এতে জ্বালানি সংকট কাটারও আশা দেখছেন তারা। তবে এলএনজি সঠিক বণ্টনের ওপর গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। আর বিদ্যুতের চলমান সংকট কাটাতে গ্যাস সরবরাহ বাড়াতে হবে জানিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্যাস সরবরাহ বাড়াতে হলে এলএনজি আমদানি বাড়াতে হবে।

প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালে এলএনজি আমদানি শুরু করে বাংলাদেশ। ২০১৮ সালের ২৪ এপ্রিল কাতারের রাস গ্যাস প্রথম এলএনজি কার্গো সরবরাহ করে। ২০১৯ সালের ৩১ জানুয়ারি কার্গো আসে ওমান থেকেও। দেশীয় কোম্পানি সামিট এলএনজি ও যুক্তরাষ্ট্রের এক্সেলারেট এনার্জির স্থাপন করা ভাসমান টার্মিনালের (এফএসআরইউ) মাধ্যমে আমদানি করা এলএনজি সরবরাহ করা হচ্ছে। এরপর ২০২০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর খোলাবাজার থেকেও এলএনজি আমদানি শুরু করা হয়।

ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দাম বেড়ে যাওয়ায় গত বছরের শেষ দিকে সরকার স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি বন্ধ করে দিলে দেশে জ্বালানি সংকট দেখা দেয়। এতে বিদ্যুতে শিডিউল লোডশেডিং করা হয়। সরকারের তরফ থেকে এক ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের কথা বলা হলেও প্রকৃত লোডশেডিং তার চাইতে বেশি ছিল। এবারের গ্রীষ্মে লোডশেডিং এড়াতে ও বিদ্যুতে গ্যাস সরবরাহ ঠিক রাখতে আবারও স্পট মার্কেটের এলএনজি কেনার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এখন স্পট মার্কেটের এলএনজির দামও কমে আসছে।

(ঢাকাটাইমস/২৮ফেব্রুয়ারি/আরআর/আরকেএইচ)