লেখালেখি ও ঈর্ষা

মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বাবু
 | প্রকাশিত : ২২ নভেম্বর ২০১৬, ১৮:৫৬

যারা লেখালেখি করে বেশির ভাগ উপেক্ষিত হয় নিজ পরিবারে, চারপাশে, দেশে। উৎসাহ দেবার সময়ে হিসাব করেন লাভ-ক্ষতি, আয়-ব্যয়। টাকার হিসাবে যারা লিখেন তারা প্রতিষ্ঠিত হয়তো হোন। আমার ধারণা মতে ৫/১০ ভাগ অর্থ উপার্জন করেন তাও খ্যাতির পর। বাকি সবাই লিখেন সময়ের প্রয়োজনে, নিজের আত্মতৃপ্তির জন্যে, নিজেকে জাহির করার জন্যে, সমাজের জন্যে, দেশের জন্যে। হাতেগোনা কেউ লিখেন কেন নিজেও জানেন না।

এজন্য অভাব, দ্ররিদ্রতাও দায়ী। অনেকেই ভেংচি কেটে বলেন, লেখালেখি গরিবের বিলাসিতার অংশ। আমি এর প্রতিবাদে বলি, লেখালেখি ঈশ্বর প্রদত্ত। লেখালেখি হতে পারে গরিবের অহংকার। কষ্ট ভুলে থাকার তাবিজ, বেঁচে থাকার অবলম্বন। দরিদ্রের অন্যায়ের প্রতিবাদ। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর বিদ্রোহী কবি নজরুলকে নিয়ে যারা গবেষণা করেন তারা আরও ভালো বলতে পারবেন। টেবিল ল্যাম্পের মৃদু আলোয় শীততাপ নিয়ন্ত্রণ কক্ষে বসে কেউ লিখে, কেউ লিখে প্রকৃতির কাছাকাছি বসে, কেউ লেখে ঘাম ঝরানো কর্মস্থলে, লেখার ভিন্নতা থাকবেই। ভরা পেটে দেশের সমৃদ্ধির স্বপ্ন, আর বেকার যুবক, দরিদ্রতার আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকা অনাহারী অর্ধাহারীর লেখায় বৈপরীত্য স্বাভাবিক নাকি অস্বাভাবিক।

দুই শ্রেণির লেখার প্রতিভা ঐশ্বরিক। জোর জবরদস্তি করে কালেভদ্রে কেউ কবি লেখক হয়ে যান, তাদেরও নিশ্চয় বর্ণমালা জানতে হয়। বাংলার মাটি, বাংলাদেশের মাটি প্রকৃতির এক অস্বাভাবিক আকর্ষণ। এই বাংলায় বিধাতা ঢেলে দিয়েছেন কিছু লেখার প্রতিভা, কথা বলার প্রতিভা। আমি অনেককে গালি দিতেও শুনেছি ছন্দময় গতিতে। এ শব্দগুলোর বিন্যাস, ব্যাখ্যা কিংবা সারিবদ্ধভাবে লিখলেও একটা কিছু লেখা হয়ে যায়। দেশপ্রেম, ভালোবাসা, প্রকৃতি, মায়া মমতা, বিবেকবোধ মানবতা, প্রতিবাদ, দ্রোহ, কল্পনা, স্বপ্ন, আবেগ, ভাবাবেগের সংমিশ্রণে প্রতিদিন রচিত হচ্ছে কবিতা, গল্প, উপন্যাস।

লেখার জগতে বড় দুশমন ঈর্ষা। সাহিত্যাঙ্গনকে বাণিজ্যিককরণের দায়ে প্রতিনিয়ত হচ্ছে প্রশ্নবিদ্ধ। আবার এছাড়া উপায় কী? বন্ধ করে দিলে সাহিত্যাঙ্গনে হয়ে যাবে শশ্মান। যত বেশি সাহিত্য সাংস্কৃতিক সংগঠন হবে, তত মানুষ মানুষের কাছাকাছি যাবে। দুর্নীতি থেকে দূরে থাকবে। প্রতিটি সংগঠনের অনুষ্ঠানাদি করতে হয়। এই অনুষ্ঠানের খরচ জোগাতে গিয়েই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত আর বদনামের ভাগিদার হচ্ছে সাহিত্যাঙ্গন। অতিথি বরণ আর অতিথি হওয়া, দুটোই ব্যয়বহুল। সামাজিক কাজে যাবেন, ব্যয় হবে, যত বড় শিল্পপতি হোন কেন, গিভ অ্যান্ড টেক, সন্মান দিন খরচ নিন পলিসি চলছে সাহিত্যাঙ্গনে এখন।

সরকারি অনুদান বা বিনা স্বার্থের অনুদান অকল্পনীয়। এখানেই মেধার মূল্যায়ন প্রশ্নবিদ্ধ! এজন্য কাকে দায়ী করবো। ছোট থেকে বড় হয়েছি চাঁদা নিয়ে। একটি পিকনিক, বনভোজন, অনুষ্ঠানের জন্য, এমনকি মাহফিলের আয়োজনে বাড়ি হেঁটে ধান চাল আদায় করার কথা ভুলে গেলেও ধারাবাহিকতা রয়ে গেছে। রিয়েলিটি শোগুলোর আয়োজন কী করে হয়, তা কি কারো অজানা? ভালো কাজে পৃষ্ঠপোষকের অভাব সব সময়।

বিড়ম্বনার যুগে এখন ব্যস্ত সময়। যত আধুনিক তত বিড়ম্বনা। প্ৰতিযোগিতা আর টিকে থাকার লড়াই। আমার দাদি অশিক্ষিত ছিলেন। মানে পাঠ্যপুস্তকের শিক্ষিত ছিলেন না। শ্লোক বলতেন, এগার সন্তানের নাতিদের সমান আদর করতেন। গল্প শোনাতেন। আমার দৃষ্টিতে দাদি, নানি, দাদা, নানা আপনার, আমার, শিক্ষিত এবং সাহিত্যিক-কবি ছিলেন, গল্পকার ছিলেন তাদের মধ্যে কোনো ঈর্ষা ছিলো না। তারা প্রকৃতিগত শিক্ষিত ও সাহিত্যিক ছিলেন।

আমার বয়স চার দশক অতিক্রম করে পঞ্চাশের দিকে ধাবিত হচ্ছে দ্রুতগতিতে। শুধু আমার না, বিশেষ করে আমাদের জেনারেশনের মায়েরা কম শিক্ষিত ছিলেন। তারা লিখেননি সত্যি, শিক্ষিত ছিলেন না সত্যি, জন্ম দিয়েছেন শিক্ষিত সমাজ। দুঃখের বিষয় এই শিক্ষিত সমাজ কিংবা অর্ধ শিক্ষিত সমাজে সহনশীলতা, ধৈর্য, কৃতজ্ঞতা, সন্মানবোধ খুঁজে পাওয়া যায় না। কাকে মেরে কে বড় হবে, কারো ভালো কেউ দেখতে পারে না। সবখানেই ধর্ম, রাজনীতি নিয়ে আসবে। চাটুকারিতা রক্তের হিমোগ্লবিনের মতো হয়ে গেছে। বেঁচে থাকার অদম্য নেশা ভাই প্রীতি। একজনের উন্নতি দেখলে আরেকজন হিংসায় জ্বলে। ঈর্ষা করে। নিজে কৃতজ্ঞ কি না এটা না ভেবেই অন্যকে অকৃতজ্ঞ বলে দেবে।

সাহিত্যাঙ্গটাকে ভালো ভেবেছিলাম, নিজে বেশি শিক্ষিত না হলেও সাহিত্যপ্রেমী ছোটবেলা থেকেই। পূর্বের খবর না জানলেও ২০১২ সালের পর থেকে যা দেখছি, তাতে নিজেই লজ্জিত হই। আমার মনের ভেতর নিজের অজান্তে পয়দা হচ্ছে ঈর্ষা! আবিষ্ট প্রভাব! ঈর্ষায় ধ্বংস হয় পরিবার, সমাজ, দেশ। একদিন ধ্বংস হবে পৃথিবী।

একজন লেখকের জীবনে আপনজনের উৎসাহ সবচেয়ে বড়। পত্রপত্রিকায় প্রকাশ, উৎসাহ বৃদ্ধি করে। সন্মান, চোখে আনে আনন্দাশ্রু। তবে আজকাল তা প্রশ্নবোধক, বিব্রতকর। প্রতিহিংসার কারণে মুখ ফিরিয়ে নেয় অনেকে।

লেখক: সিঙ্গাপুর প্রবাসী

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :