স্বপ্নভঙ্গের দেশের ভোট রঙ্গ

তুষার আবদুল্লাহ
 | প্রকাশিত : ২৫ নভেম্বর ২০১৬, ১২:৪৯

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য যখন রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেট দল তাদের প্রার্থী চূড়ান্ত করল, তখন ধরে নেওয়া হয়েছিল এবারের নির্বাচনে আমিষ থাকছে না। সাবেক সিনেটর, ফার্স্ট লেডি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের প্রতিপক্ষ হিসেবে আবাসন ব্যবসায়ী, টেলিভিশনের রিয়েলেটি শো উপস্থাপক ডোনাল্ড ট্রাম্পের ধোপে টেকার কথা নয়। একেবারে কুঁড়িতেই আমেরিকার বাইরের মানুষেরা ধরে নিয়েছিল হোয়াইট হাউসে এবার বিল ক্লিনটন ঢুকবেন হিলারি ক্লিনটনের হাত ধরে।

হিলারি ক্লিনটন আগামী দিনে প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিশ্বরাজনীতি পরিচালনা করবেন, তা ধরে নিয়েই বিশ্বরাজনীতির নয়া মেরুকরণের নকশা আঁকা শুরু হয়ে গেছিল। এই দুই প্রার্থী যখন নির্বাচন পূর্ব বিতর্কে অংশ নিলেন, তখন দুইজনার তফাৎ আরো ফকফকা হয়ে গেল। তিনটি বিতর্কেই ট্রাম্প ধরাশায়ী হোন হিলারির কাছে। ট্রাম্প দ্রুত বিতর্কিত হতে থাকেন অশোভন ও বিদ্বেষমূলক উক্তির মাধ্যমে। তিনি নারীদের, অভিবাসীদের এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ এবং অশোভন বক্তব্য দেন। একই সঙ্গে তার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি, সেক্স স্ক্যান্ডালের অভিযোগ উঠতে থাকে একের পর এক। দশজন নারী ট্রাম্পের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলে। প্রকাশিত হতে থাক সেক্স টেপ। এমনকি নিজের মেয়েকে নিয়েও তিনি যৌনতা মিশ্রিত মন্তব্য করেছেন।

এই পরিস্থিতিতে নির্বাচন আসার আগেই আমেরিকার বাইরের মানুষেরা হিলারি ক্লিনটনকে হোয়াইট হাউসের পথে হাঁটাতে শুরু করেছিল। সেই হাঁটাতে আরো গতি এনে দেয় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম। হিলারি মার্কিন মসনদে বসতে যাচ্ছেন এটা প্রায় নিশ্চিত হয়েই বিশ্ব রাজনীতির মেরুকরণের নয়া নকশা তৈরি হতে থাকে। বাংলাদেশও হিলারি ক্লিনটন ক্ষমতায় বসলে স্থানীয় রাজনীতিতে কি প্রভাব পড়তে পারে, এ নিয়ে হিসাব কষতে শুরু করে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের এই চিত্র পূর্বাভাস দিচ্ছিল নির্বাচন কভার করার বিষয়টি আনন্দ ভ্রমণে রূপ নিতে পারে। ২০১২ সালে বারাক ওবামা এবং মিট রমনি যখন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন, তখনকার চিত্রটি প্রায় একই ছিল। এই বিবেচনায় এক ছিল যে, বারাক ওবামা দ্বিতীয় দফায় প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন এটা প্রায় নিশ্চিতই ছিল। যদিও মিট রমনি কোনো অশোভন বক্তব্য দিয়ে ভোটের হাওয়া একদিকে বয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেননি। তারপরও সেই নির্বাচনকেও আগে থেকে নিরামিষই মনে হচ্ছিল। তবু যাওয়ার নিয়ত করেছিলাম এজন্য যে, নির্বাচন সেটি ইউনিয়ন পরিষদ হোক কিংবা জাতীয় সংসদ, সেটি কভার করার এক প্রকার নেশা রয়েছে। দীর্ঘদিন নির্বাচন কমিশন বা নির্বাচনি রিপোর্টিং করেছি। তাই মার্কিন নির্বাচন কভারের স্বাদ নিতেই ২০১২ সালে যুক্তরাষ্ট্র যাত্রা করেছিলাম। একথা সত্য সেইবার নির্বাচন কভার করার চেয়ে বেশি রিপোর্ট করা হয়েছিল ঘূর্ণিঝড় স্যান্ডি নিয়ে। স্যান্ডির আঘাতে সেইবার পুরো আমেরিকা প্রায় বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। বিশেষ করে নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো দীর্ঘদিন পানির নিচে তলিয়ে ছিল। বিঘিœত হয়েছিল জ্বালানি তেল ও পণ্য সরবরাহ। এই নির্বাচনকে পাশে রেখে এই রিপোর্টই তখন দর্শকরা লুফে নিচ্ছিল। তারপরও ভোটদান প্রক্রিয়া, ভোটের আগের জরিপ, অঙ্গরাজ্যগুলোর ওপর জয়-পরাজয় নির্ধারনের হিসাবগুলো জানতে পেরেছিলাম। অতএব ২০১২ সালের নির্বাচন শেষ পর্যন্ত আর নিরামিষ থাকেনি।

এবার নিরামিষের পূর্বাভাস থাকার পরেও ঝুঁকি নিয়েই যাত্রা করেছিলাম। প্রত্যাশা ছিল দুর্ঘটনার। আবাসন ব্যবসায়ী ডোনাল্ড ট্রাম্প শুরু থেকেই যে কৌশল নিয়েছিলেন, সেই কৌশলটিই ছিল সন্দেহজনক এবং ঝুঁকি নিতে প্ররোচিত করেছে। ভোটের মাঠে দ্রুত আলোচনায় আসার জন্য তিনি কিছু সংবেদনশীল জনগোষ্ঠীকে বেছে নিয়েছিলেন। তিনি ভালো করেই জানেন আমেরিকা অভিবাসীদের দেশ। প্রতিবছর সেখানে অভিবাসীদের ভিড় বাড়ছে। এই অভিবাসীদের নিয়ে কথা বললে দেশজুড়ে প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। তিনি অভিবাসীদের নিয়ে কথা বললেন, যুক্তরাষ্ট্র তেঁতে উঠল। আর একটি স্পর্শকাতর বিষয় ধর্ম। তিনি মুসলমানদের নিয়ে কথা বললেন, বিশ্ব উত্তপ্ত হলো। নারীদের নিয়ে কথা বললেন, তাকে নিয়ে শুরু হলো বিতর্ক এবং জনপ্রিয় হওয়া, সবার মুঠোতে নিজের নামটি নিয়ে যাওয়ার জন্য, সব আড্ডায়, আড়ালে ফিসফিস কথোপকথনে নিজেকে হাজির করতে বাজারে ছাড়লেন নিজের সেক্স স্ক্যান্ডাল। দশজন নারীকে দিয়ে তার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ তোলালেন। ভোটারদের সুড়সুড়ি দিয়ে জাগাতে নিজের মেয়ের সম্পর্কেও যৌনতা মিশ্রিত কথা বললেন। ফলাফল ভোটের বাজারে হিলারি ক্লিনটনের চেয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নামটিই বেশি উচ্চারিত হলো। যদিও গণমাধ্যম তাদের কৃত্রিম জরিপে হিলারিকেই এগিয়ে রাখছিল। এই যখন এবারের নির্বাচনের পূর্বাভাস, তখন একপেশে নির্বাচন কভার করতে যাওয়াও স্রেফ বিনোদনমূলক বা ভ্রমণপ্রধান হয়ে উঠার কথা। কারো কারো জন্য অবশ্য এই সুযোগে যুক্তরাষ্ট্রে পা রাখা, আগামীর স্থায়ী বন্দোবস্তকে ভাবনায় রেখে। আমার ভাবনায় তেমন কোনো আগামী ছিল না।

তারপরও যাওয়া কোনো দুর্ঘটনার স্বপ্ন নিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রে রওনা হওয়ার আগে আমার সঞ্চালিত অনুষ্ঠানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন নিয়ে একাধিকবার কথা হয়েছে। সেখানে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক ও সাবেক কূটনীতিকরা হিলারি ক্লিনটনকে এগিয়ে রেখেছিলেন ঠিকই, পাশাপাশি তাদের কেউ কেউ দৃঢ়ভাবেই দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার ইংগিত দিয়ে রাখছিলেন। অর্থাৎ ট্রাম বাজিমাত করে ফেলতে পারেন। এই ইংগিতের পেছনে যুক্তি ছিল। সেখানে মার্কিন রাজনীতি ও সেই দেশের নাগরিকদের চিন্তার বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে শ্বেতাঙ্গরা ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথা আমলে নিতে পারে। কারণ তারা এই বাস্তবতা দেখছে যে, অভিবাসীদের সঙ্গে তারা চাকরির বাজারে টিকতে পারছে না। তারা ক্রমশ সংখ্যালঘু হয়ে পড়ছে। তারা নিজেদের অস্তিত্ব আঁকড়ে রাখতে চায়। পাশাপাশি তারা দেখছিল হিলারি ক্লিনটন ওবামা প্রশাসনেরই ধারাবাহিকতা রাখবেন। নতুন কিছু নিয়ে তিনি আসছেন না। কিন্তু আমেরিকার মানুষ পরিবর্তন চাচ্ছিল।

এ ছাড়া আমেরিকার জনগণ আরেকটি বিষয়ে প্রস্তুতি শেষ করতে পারেনি, সেটা হলো নারীকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখার। যে দেশ নারীকে ভোট দেওয়ার অধিকার দিতে প্রায় দুই শতকের প্রস্তুতি নিয়েছে, তারা এত জলদি নারীকে মসনদে বসাবে না। এই অঙ্কগুলো বিবেচনায় রেখেই দুর্ঘটনার একটা পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছিল। আর। আমেরিকার আবহাওয়ার পূর্বাভাসের ওপর নাকি ভরসা করা যায়, সেই ভরসাতেই উড়াল দেওয়া স্বপ্নভঙ্গের দেশে!

আমেরিকা থেকে ফিরে

তুষার আবদুল্লাহ : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও গণযোগাযোগ বিশেষজ্ঞ

ঢাকাটাইমস/২৫নভেম্বর/টিএ/টিএমএইচ

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :