কল্যাণকর রাষ্ট্রের স্বপ্ন

আহমাদ মোস্তফা কামাল
  প্রকাশিত : ১৮ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৩:০০| আপডেট : ১৮ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৩:০৩
অ- অ+

বাড়ির ভেতরে, গলির মোড়ে, চায়ের দোকানে, হোটেল-রেস্তোরাঁয়, হাটে-বাজারে, অফিস-আদালতে, বন্ধুদের আড্ডায়, আত্মীয়-স্বজনের মিলনমেলায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে- সর্বত্র আমরা কথা বলে চলি। কথা বলি একটা কমন বিষয় নিয়ে- দেশ, দেশের অবস্থা। এ দেশটার কী হবে, এই নিয়ে আমাদের দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। আমরা ক্রমাগত কথা বলে চলি, হাহাকার করি, শঙ্কায় ভুগি, উত্তেজনায় ফেটে পড়ি, কখনো বা আমাদের দু’চোখ ভরে ওঠে জলে। আমরা সাধারণ মানুষ, সংসার চালানো আর ক্ষুণ্নিবৃত্তির চেষ্টায় আমাদের উদয়াস্ত পরিশ্রম করতে হয়; প্রতিদিনের চাল-ডাল-নুন-মরিচ জোগাড়ের দায়, নিজেদের আর স্বজনদের নিরাপদ জীবনের জন্য উৎকণ্ঠা, সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তাÑএর বাইরে তো আমাদের আর কিছু থাকার কথা নয়! নয় বটে, তবু আছে। আর দশটি দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানোর দায় ছাড়াও আমাদের সবার মন ও মস্তিষ্কে ‘দেশ’ নামক একটা ব্যাপার থেকেই যায়। চারপাশে একটু কান পাতলেই বোঝা যায়, শ্রেণি-পেশা-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষ দেশের কথা বলছে, ভাবছে আর দুশ্চিন্তা ও উৎকণ্ঠা প্রকাশ করছে। যে দেশের প্রায় শতভাগ মানুষ দেশের কথা ভাবে, সেই দেশকে নিয়ে তো আশা করাই যায়। আর আশা করার মতো অনেক অর্জনও আছে আমাদের। আমরা সংগ্রাম করে মাতৃভাষাকে মর্যাদার আসনে বসিয়েছি, যুদ্ধ করে স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে এনেছি- এ ঘটনাগুলোই তো বলে দেয়, কারো দয়ার দানে নয়, নিজেদের অধিকার নিজেরাই আদায় করে নেওয়ার সাহস ও যোগ্যতা আমাদের আছে। শুধু কি তাই? যখন দেশটি স্বাধীন হয়েছিল, সাড়ে সাত কোটি মানুষের দেশ, অথচ তাদের খাদ্যের সংস্থান ছিল না। আর এই ৪৫ বছর পর, মানুষ বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি, চাষের জমি বাড়েনি এক ইঞ্চিও, বরং কমেছে অনেকখানি। তবু আমরা খাদ্যে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি। এ তো এদেশের কৃষকদের অভূতপূর্ব কর্মদক্ষতা আর পরিশ্রমেরই ফসল। এ অভাবিত সাফল্যের কথা ভাবলেই তো বুকটা ভরে ওঠে। মনে হয়, মানুষের চেষ্টা, পরিশ্রম ও স্বপ্নের জোরেই এ দেশ এগিয়ে যাবে সামনের দিকে।

অথচ কী আশ্চর্য, একটা কথা প্রায়ই শোনা যায়- বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা নাকি এর জনসংখ্যা! ‘ছোট্ট একটা দেশ, এত এত মানুষ, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারও আশঙ্কাজনক- এ দেশের আর ভবিষ্যৎ কী?’ এ ধরনের কথা যারা বলেন, আমি নিশ্চিত, তারা নিজেদের ওই ‘জনসংখ্যা’র অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করেন না এবং কথাগুলোর মধ্যে জনগণের প্রতি এক ধরনের সূক্ষ্ম তাচ্ছিল্য থাকে। এ তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার কাজটি রাষ্ট্রও সোৎসাহে করে থাকে। জনগণকে ‘সম্পদ’ মনে না করে ‘বোঝা’ মনে করা যে শেষ পর্যন্ত আত্মঘাতী চিন্তারই নামান্তর, সেটি তাদের মনে থাকে না। যে দেশের মানুষ এত পরিশ্রমী, যে দেশের কৃষকরা ১৬ কোটি মানুষের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে, যে দেশের শ্রমিকরা দিনরাত পরিশ্রম করে পোশাকশিল্পকে বিশ্ববাজারে আকর্ষণীয়রূপে হাজির করেছে, সেই দেশে জনগণ আর বোঝা হিসেবে গণ্য হবে না। বরং পরিণত হবে সম্পদে, যাপন করবে একটি সম্মানজনক জীবনÑএটাই কি আমাদের কাম্য হওয়া উচিত নয়? রাষ্ট্র তো এখানে নিপীড়কের ভূমিকা পালন করার কথা নয়, বরং বন্ধুর মতো পাশে এসে দাঁড়ানোর কথা। দাঁড়াচ্ছে না বলেই ওই ক্ষোভটুকু জন্মাচ্ছে আমাদের মনে।

স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরও রাষ্ট্রীয় নানা বিষয়ে আমরা তর্ক করে চলেছি। কতগুলো মৌলিক বিষয়ে কেউ কারো সঙ্গে একমত হতে পারছি না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই রাজনৈতিক দলগুলোর আদর্শ ও কর্মসূচিতে ভিন্নতা ছিল, আছে এবং থাকবে। কিন্তু এ মতভিন্নতা-মতবিরোধ থাকা সত্ত্বেও বেশির ভাগ দেশেই রাষ্ট্রের দর্শন-আদর্শ-মূলনীতি সম্পর্কে এক ধরনের জাতীয় ঐকমত্য আছে এবং রাজনৈতিক দলগুলো এসব আদর্শ নিয়ে অহেতুক বিতর্ক তৈরি করে না। বাংলাদেশে সে ধরনের কোনো জাতীয় ঐকমত্য তৈরি হয়নি এবং না হওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোই সবচেয়ে বেশি দায়ী। তারা নিজেদের দলের আদর্শ রাষ্ট্রের কাঁধে চাপিয়ে দিতে চেয়েছে, কিন্তু একবারও জানার চেষ্টা করেনি যে, এ রাষ্ট্রের বাসিন্দারা এই আদর্শ আদৌ মানবে কি না! স্বাধীনতার পর যেসব আদর্শকে রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল সেগুলোর কোনো বিশেষ দলের আদর্শ ছিল না বরং মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে উঠে আসা ওই আদর্শে ছিল জাতির আশা-আকাক্সক্ষা-স্বপ্ন-প্রত্যাশার প্রতিফলন, যে জাতি এক বিপুল ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে, রক্তপাত ও জীবনদানের বিনিময়ে এই স্বাধীনতা অর্জন করে নিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ ঘটেছিল একটি জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এবং সেটিতে কতিপয় জাতিদ্রোহী স্বাধীনতাবিরোধী ছাড়া সবাই স্বতঃস্ফূর্ত অংশ নিয়েছিল। তাই ওই আদর্শগুলো নিয়ে কারো দ্বিমত ছিল না। কিন্তু পরবর্তীকালে এগুলোকে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগেই বিতর্কিত করা হয়েছে। ফলে এখন এক দল বাংলাদেশি তো আরেক দল বাঙালি, একদল রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে ইসলাম ধর্মের একাধিপত্যে বিশ্বাসী তো আরেক দল ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ^াসী। এ ধরনের জটিলতা আর কোনো দেশে আছে কি না সন্দেহ। স্বাধীনতার এত বছর পরও এসব নিয়ে আমাদের কথা বলতে হচ্ছে, যদিও অনেক আগেই এগুলোর মীমাংসা হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু হয়নি বলে যে কোনোদিন হবে না, তা তো নয়। আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে এই দাবি জানাতে পারি- তাদের দলীয় আদর্শ যা-ই হোক না কেন, রাষ্ট্রীয় আদর্শগুলোর বিষয়ে সব দল একমত হয়েই একটি সম্মিলিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন এবং সংসদে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে এর প্রতিফলন ঘটাবেন। তবে একটি কথা না বললেই নয়, এ আদর্শগুলো অতি অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে সামনে রেখে নির্ধারণ করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধই আমাদের বাতিঘর, একমাত্র এ একটি বিষয়ই জাতিকে যেকোনো সময় যেকোনো পরিস্থিতিতে এক সুতোয় গেঁথে দিতে পারে।

এ তো গেল রাষ্ট্রীয় আদর্শের বিষয়, দলীয় আদর্শ ও কর্মসূচি? সেটিও যে যার মতো করে ঠিক করে নিতে পারে। তবে সেটি অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের আকাক্সক্ষা ও অর্জনের বিপরীতে হওয়া চলবে না। আর এ কর্মসূচির মূলে থাকতে পারে দেশের অর্থনেতিক কর্মকা- পরিচালনার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট আদর্শ ও পরিকল্পনা ঘোষণা। বাংলাদেশের বড় দুটি দল তাদের অর্থনৈতিক আদর্শ হিসেবে মুক্তবাজার অর্থনীতির আদর্শকে গ্রহণ করেছে অনেক আগেই, কিন্তু এ আদর্শ আমাদের দেশের জন্য যে কল্যাণকর হয়নিÑএ কথা এখন সবাই স্বীকার করেন। যে দেশের ৭০ শতাংশ মানুষ দরিদ্র, বাদবাকিদের অনেকেরই নুন আনতে পান্তা ফুরায় দশা, সে দেশের বাজারকে উন্মুক্ত করে দেওয়ার চিন্তা করাটা শুধু উন্মাদের পক্ষেই সম্ভব। যা হোক, বুর্জোয়া দলগুলোর যেসব সীমাবদ্ধতা থাকে সেসব কারণেই বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় তাদের পক্ষে পুরোপুরিভাবে মুক্তবাজার অর্থনীতির বিরুদ্ধে যাওয়া সম্ভব নয়। সম্ভব না হলেও, এর বিশাল থাবা ও গ্রাসকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে রাখার কোনো বিকল্প নেই। সেজন্য প্রয়োজন একটি কল্যাণমুখী অর্থনীতির আদর্শ ঘোষণা করা এবং সে ঘোষণা বাস্তবায়নের চেষ্টা করা।

জনগণের মৌলিক অধিকার বলে স্বীকৃত যেসব বিষয় আছে সেগুলোর বাস্তবায়ন সম্ভব শুধু রাষ্ট্রের চেষ্টাতেই। বাংলাদেশের এক বিপুল জনগোষ্ঠী গৃহহীন-ভূমিহীন-উদ্বাস্তু। নদীভাঙন বা এ ধরনের কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে বা মনুষ্যসৃষ্ট কোনো দুর্যোগের শিকার হয়ে এ মানুষগুলো ভিটেমাটি হারিয়ে শহরে এসে ভিড় জমায়। এতে শহরের ওপর যেমন চাপ পড়ে, তেমনি তাদের জীবনের নেমে আসে অকল্পনীয় বিপর্যয়। স্বাধীনতার পর থেকে এ ধরনের মানুষের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে, অথচ কোনো সরকারই সমস্যাটির দিকে দৃষ্টিপাত করেনি। যদিও এর সমাধান করা অসম্ভব কিছু নয়। বাংলাদেশের যে বিপুল পরিমাণ খাসজমি আছে, যা বিভিন্ন তথাকথিত প্রভাবশালীদের দখলে রয়ে যাচ্ছে বছরের পর বছর, সেগুলো উদ্ধার করে যদি এর চার ভাগের এক ভাগও গৃহহীন-ভূমিহীনদের মধ্যে বণ্টন করা যায়, তাহলে বাংলাদেশে কোনো উদ্বাস্তুই থাকবে না। এ কাজটি করা কি অসম্ভব? ওই প্রভাবশালীরা কি সরকারের চেয়েও প্রভাবশালী? আসলে কোনো সরকারই ভূমি সংস্কারের কথা ভাবেনি, ভাবলে সম্ভব হতো।

এ দেশের প্রতিটি জেলা-উপজেলায় সরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হাসপাতাল আছে। একটি দরিদ্র দেশে এত বড় একটা ব্যাপার কল্পনা করা যায়? কিন্তু সমস্যা হলো, হাসপাতালগুলো কার্যকর করা যাচ্ছে না প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাবে, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাবে। এ সমস্যার সমাধান করা কি অসম্ভব? না, মোটেই অসম্ভব নয়। সরকারের সদিচ্ছাই এই ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে। শুধু হাসপাতাল কেন, প্রতিটি জেলা-উপজেলায় আছে সরকারি স্কুল-কলেজ, এগুলোকে মানসম্মত করে তুলতে পারলেও তো শিক্ষাক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটে যায়। অর্থাৎ আমাদের যা কিছু আছে সেগুলোর যথাযথ কার্যকারিতা নিশ্চিত করা গেলেই অনেক ক্ষেত্রে বিপুল পরিবর্তন দৃশ্যমান হয়ে উঠবে। দরকার শুধু রাষ্ট্রের সদিচ্ছা ও উদ্যোগ।

আরেকটি কথা। দেশে বহুমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু রেখে জাতীয় ঐকমত্য তৈরি করা অসম্ভব। শিশুরা কেউ পড়বে সাধারণ স্কুলে, কেউ পড়বে মাদ্রাসায়, কেউ বা পড়বে ইংরেজি মাধ্যমে, কেউ পড়বে ক্যাডেট কলেজে আর বড় হয়ে তারা কোনো একটি বিষয়ে একমত হবেÑএ রকম আশা করা বাতুলতা মাত্র। আমাদের নীতিনির্ধারকরা কেন এসব নিয়ে ভাবেন না, বোঝা কঠিন। একটি বিজ্ঞানভিত্তিক, গণমুখী, আধুনিক, একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা ছাড়া এ দেশের সার্বিক মুক্তি সম্ভব নয়। সে কাজটি কবে শুরু হবে?

বলাবাহুল্য, কথাগুলো যত সহজে বলা হলো, সেটি বাস্তবে পরিণত করা এর চেয়ে হাজার গুণ কঠিন। এটি এক দিনের কাজও নয়। তবে উদ্যোগ নিলে অন্তত এক যুগের মধ্যে নিশ্চয়ই এসব মৌলিক সমস্যা সমাধান করে বিপুল মানবিক বিপর্যয় থেকে জাতিকে রক্ষা করা সম্ভব হবে। জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তর করার তাগিদ থেকেই এটি করতে হবে। এ পর্যন্ত আমরা তা করে উঠতে পারিনি; বরং ক্রমাগত প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে দিয়ে, মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য করে তাদেরকে জাতির বোঝা হিসেবে চিহ্নিত করেছি। কিন্তু স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে যেন আমরা এমন একটি দেশ দেখতে পারি, যেখানে জনগণ আর বোঝা হিসেবে গণ্য হবে না বরং পরিণত হবে সম্পদে, যাপন করবে একটি সম্মানজনক জীবন।

আহমাদ মোস্তফা কামাল : কথাসাহিত্যিক

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
বৈষম্যবিরোধী ও এনসিপির আন্দোলনের মুখে পটিয়া থানার ওসি প্রত্যাহার
বাংলামোটরে এনসিপির জুলাই চিত্র প্রদর্শনীর গাড়িতে ককটেল বিস্ফোরণ
তাড়াশে সম্পত্তি লিখে নিয়ে বাবা-মাকে বাড়িছাড়ার অভিযোগ
সাবেক এমপি নাঈমুর রহমান দুর্জয় গ্রেপ্তার
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা