‘বাড়ি আসব না’ বলেই চলে গেলেন মতিন

বাড়ি থেকে আব্দুল মতিনের কর্মস্থলের দূরত্ব চার কিলোমিটার। অধিকাংশ সময় তিনি রাতের ডিউটিতে থাকতেন। প্রতিদিন সকালে বাড়ি এসে নাস্তা করে আবার কর্মস্থলে যেতেন। দুপুরে বাড়িতে গিয়ে খেয়ে রাতের জন্য খাবার সঙ্গে নিয়ে যেতেন। বৃহস্পতিবার সকালেও তার রুটিনটা এমনই ছিল। কিন্তু হঠাৎ সকালে স্ত্রী তানজিলাকে ফোন করে জানান, জঙ্গিবিরোধী অভিযানে অংশ নিচ্ছেন তিনি। আর এজন্য সকালের নাস্তা বাড়িতে গিয়ে করতে পারবেন না। সুযোগ হলে দুপুরে গিয়ে খাবেন। কিন্তু দুপুরে তার আর বাড়ি ফেরা হয়নি। এক নারী জঙ্গির হাসুয়ার কোপে ঝরে গেল তার জীবনপ্রদীপ।
গতকাল রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলায় সন্দেহভাজন জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের সময় আস্তানাটিতে পানি স্প্রে করছিলেন আব্দুল মতিন। এ সময় বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে এক নারী জঙ্গি তাকে কুপিয়ে হত্যা করেন। ঘটনার সময় ধারণ করা এক ভিডিও ফুটেজে এমন চিত্রই দেখা গেছে।
বৃহস্পতিবার রাতে গোদাগাড়ীর মাটিকাটা ইউনিয়নের মাটিকাটা ভাটা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, আবদুল মতিনের মৃত্যুতে শোকে মূহ্যমান গ্রামবাসী। বহু মানুষ ভিড় করছেন মতিনের বাড়িতে। তারা জানিয়েছেন, আবদুল মতিন ছিলেন গ্রাম প্রধান। গ্রামে তাকে সবাই খুব সম্মান করতেন। তার এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না কেউ।
নিহত মতিনের স্ত্রী তানজিলা খাতুন বলেন, ‘খুব ভোরে ফোন করে বলল-সকালে বাড়ি আসব না। সুযোগ হলে দুপুরে যাব। সুযোগ হলো না। দুপুরে এলো না। আসল বিকালে তাও লাশ হয়ে। আমি সব হারিয়ে ফেললাম।’
আবদুল মতিনের ছোট ভাই সাদ্দাম হোসেন জানালেন, তারা চার ভাই। মতিন ছিলেন সবার বড়। ভাইদের মধ্যে একমাত্র চাকরিজীবীও ছিলেন তিনি। অন্যরা সবাই কৃষিকাজ ও ব্যবসা করেন। এ জন্য সব ভাই মতিনকে খুব সম্মান করতেন। বাবা মারা যাওয়ায় মতিনই সব ভাইদের প্রতি খেয়াল রাখতেন।
সাদ্দাম হোসেন আরও জানান, ‘একটু রাত হলে ভাই ফোন করতেন। বলতেন- দেশের অবস্থা ভালো না। বাইরে রাত করিস না। তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে আয়। দেশের অবস্থা এতোই খারাপ! আমার ভাইকে প্রাণ দিতে হলো।’
পাশেই থাকা আবদুল মতিনের ভাগ্নে লুৎফর রহমান বললেন, ‘অভিযানের যে ভিডিও দেখছি, তাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন আছে। সেসব কথা বলতে চাই না। শুধু বলতে চাই- এমন বড় অভিযানের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে যেন মেডিকেল টিমও প্রস্তুত থাকে। তাৎক্ষণিক চিকিৎসা পেলে হয়তো মামা মরতেন না।’
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশন) একেএম শাকিল নেওয়াজ জানান, কর্মী আবদুল মতিনের মৃত্যু কীভাবে হয়েছে তা অনুসন্ধানে রাজশাহী ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ-পরিচালক নুরুল ইসলামকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে কমিটি তাদের প্রতিবেদন দেবে।
ভিডিওতে দেখা গেছে, ধারালো অস্ত্র দিয়ে এক নারী জঙ্গি মতিনকে কোপাচ্ছে।এতে তার বাম কানের অর্ধেক অংশ কেটে নিচের দিকে ঝুলে গিয়েছিল। তদন্ত কমিটি এসব বিষয়ই তদন্ত করবে। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো অসতর্কতা কিংবা অবহেলা ছিল কি না তাও খতিয়ে দেখবে কমিটি।
মাটিকাটা ভাটা গ্রামের এহসান আলীর ছেলে আবদুল মতিন এইচএসসি পাস করে ১৯৯৩ সালে ফায়ার সার্ভিসে যোগ দিয়েছিলেন। বিবাহিত জীবনে তিনি দুই সন্তানের বাবা। বড় মেয়ে জেসমিন আক্তার পড়ে নবম শ্রেণিতে। আর ছোট ছেলে মারুফ হোসেন ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। মতিনের এমন মৃত্যুর পর বার বার কান্নায় ভেঙে পড়ছেন স্ত্রী তানজিলা খাতুন। সাটোর্ধ্বে বৃদ্ধা মা বাদেনুর বিবিও জ্ঞান হারাচ্ছেন কিছুক্ষণ পরপর।
নিহত আবদুল মতিনকে সন্ধ্যায় স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকালের জঙ্গিবিরোধী ওই অভিযানে পাঁচ জঙ্গিও নিহত হয়েছে। এদের মধ্যে একই পরিবারের দুই নারীসহ চারজন রয়েছে। তাদের মরদেহগুলো জঙ্গি আস্তানার পাশে কেটে নেওয়া ধানের জমির খেতে পড়ে আছে। ঘটনাস্থলে পৌঁছেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার বোমা বিশেষজ্ঞ দল।
সকালে জঙ্গি আস্তানার বাইরে এসে এক নারী আত্মসমর্পণ করেছে। উদ্ধার করা হয়েছে তার দুই শিশু সন্তানকেও। অভিযানে মতিনের মৃত্যুর পাশাপাশি দুই পুলিশ সদস্যও আহত হয়েছে। তবে বাড়িটির ভেতরে এখনও অভিযান চালানো হয়নি। বৃহস্পতিবার রাতে অভিযান স্থগিত করার পর আজ সকালে আবারও অভিযান শুরু করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
ঢাকাটাইমস/১২মে/আরআর/এমআর

মন্তব্য করুন