এফডিসির সেই লাইটম্যানকে আমি ভুলিনি

আব্দুন নূর তুষার
 | প্রকাশিত : ১০ নভেম্বর ২০২০, ১৫:৪৪

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হলো রোগের জাদুঘর। এখানে কঠিন ও দুষ্প্রাপ্য রোগীরা আসেন। যে রোগ লাখে একটা হয়, সেটাও এখানে পাওয়া যায়। আমাদের ওয়ার্ডে আমরা পেলাম এক মিলিয়ারি টিউবারকিউলোসিসের রোগী। যক্ষ্মা তার ফুসফুসে অসংখ্য সাদা সাদা ছিদ্রের মতো ছায়া ফেলেছে এক্স-রের ছবিতে।

এখন কোভিড-১৯ এ কারও কারও এমন ছবি আমরা পাচ্ছি। অধ্যাপক নেসারউদ্দিন আহমেদ তাকে স্ট্রেপটোমাইসিন ইঞ্জেকশন দিতে বললেন। রোগীর রক্তে হিমোগ্লোবিন খুব কম। আমরা তাকে রক্ত দিলাম। পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা করলাম। আমেরিকা থেকে আইভি নিউট্রিশন আমদানি হতো তখন। চাঁদা তুলে সেটাও দিয়েছিলাম পুয়োর ফান্ড থেকে। এটা আমাদের দেয়া টাকা এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও দয়ালু মানুষের দানের টাকায় চলতো। আমি এটার পরিমাণও বাড়িয়ে ফেলেছিলাম বন্ধু-বান্ধব থেকে শুরু করে যত মামা-চাচা আছে সবার পেছনে লেগে থেকে। ওয়ার্ডে একটা হুইল চেয়ার নিয়ে এসেছিলাম রোটারী ক্লাবের টাকায় যাতে হুইল চেয়ারের জন্য এদিক-সেদিক টানাটানি না লাগে।

রোগী এফডিসির লাইটম্যান ছিলেন। ইবনে মিজান, দেলোয়ার জাহান ঝন্টু থেকে শুরু করে কাজী জহির আর এহতেশামের গল্প করেন। নানা রকম ছবির নাম বলেন। বলেন রাজা-রাজড়ার ছবিতে নাচ গান থাকে, লাইট বেশি লাগে। কারণ এগুলো বেশির ভাগ এফডিসির মধ্যেই শুটিং হয়। আর্ট ফিল্মে লাইট কম লাগে। তাই তিনি আর্ট ফিল্ম বেশি ভালোবাসেন না। কাজ কম, টাকা কম। রোগী ইঞ্জেকশন দেয়ার সময় চিৎকার করে, ব্যথার অভিযোগ করে। নার্সরা তাকে ইঞ্জেকশন দিতে চায় না। বলে রোগী কো-অপারেট করে না। আমি নিজ হাতে তাকে ইঞ্জেকশন দিতাম। রোগী তখন কোনো ব্যথার কথা বলে না। কোনো চিৎকার-চেঁচামেচিও করে না।

একদিন আমার অফ ডে। আমি ছিলাম না। রোগী ইঞ্জেকশন নেবে না বলে গোঁ ধরেছে। আমি ছাড়া সে ব্যথা পায়।

আমি কারণটা জানতাম। যতক্ষণ ধীরে ধীরে আমি ইঞ্জেকশন দিতাম, ততক্ষণ আমি তার সাথে গল্প করতাম। কথা বলতাম। শুরুতেই বলতাম, ব্যথা পেলে আমাকে বলবেন। শেষ করে হাত ধরে বলতাম ব্যথা পাননি তো?

গল্পের মধ্যে রোগী ব্যথার দিকে মন দেয়ার সময় পেতো না। নিজেই নানারকম গল্প আমাকে শোনাতো। কোনো এক ছবিতে জাভেদ উপর থেকে লাফ দিয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়বে। যতবার সে ঘোড়ার পিঠে লাফ দিয়ে ওঠে ততবার ঘোড়া হাঁটু ভেঙে বসে পড়ে। আমাকে বলে স্যার, ঘোড়ারও তো খাবার লাগে, এটা লোকে বোঝে না। যেমন বোঝে না নায়ক-নায়িকা ছাড়াও সবার খাবার লাগে। আমাদেরও। লাইটম্যানদের কথা কে ভাবে? সে রাজ্জাক সাহেবের খুব প্রশংসা করতো। তিনি নাকি সবার খোঁজ নিতেন। আমি এসবের সত্য-মিথ্যা জানি না। তবে তাকে গল্প ধরিয়ে দিলেই সে গল্প করতো আর আমার ব্যথামুক্ত সুঁই তাকে ওষুধ দিতো।

একদিন আবার আমার অফ ডে। পরদিন গিয়ে দেখি রোগীর বেড শূন্য। আমি জানতে চাওয়ার আগেই নার্স বলে- ডক্টর, রোগী কি আপনার আত্মীয় ছিল? আমি বললাম না। বললো গতরাতে রোগী এক্সপায়ার করেছে। তবে খারাপ হয়ে যাওয়ার সময় আপনার কথা বলছিল। বলছিল আমার ডাক্তারকে ডাকেন।

আমি স্বভাবতই মন খারাপ করে কিছুক্ষণ বসে থেকেই আবার আমার বেডগুলোর রোগীদের ফলোআপ শুরু করলাম। স্যার রাউন্ডে আসার আগে সব ফাইল আপডেটেড থাকতে হবে। আমি জানি এই রোগী নিয়ে সপ্তাহ শেষে ক্লিনিক্যাল ডিসকাশন হবে। সেটা আমি সমন্বয় করি। ওয়ার্ডের নোটিশ বোর্ডের একটাকে জার্নাল ক্লাব নাম দিয়ে সেখানে জার্নাল থেকে ফটোকপি করা ভালো ভালো আর্টিকল পিন করি আমি। সেগুলো নিয়ে স্যার, জাকির ভাই, ওয়াদুদ ভাই কথা বলেন। আমার কত কাজ। পরের ব্যাচের ক্লাসের জন্য ওয়ার্ডের রোগীদের বেছে রাখি।

কিন্তু এই এফডিসির লাইটম্যানকে আমি ভুলিনি। রোগী ব্যথা পাবেই এই ইঞ্জেকশনে। আমি ইঞ্জেকশন দেয়ার সময়ও সে ব্যথা পেতো। আমার সাথে গল্পের কারণে ব্যথার কথা বলতে ভুলে যেতো।

নার্সরা কেবল ইঞ্জেকশন দিয়ে যান। গল্প করার সময় কই। তাদের সংখ্যা ডাক্তারের অর্ধেক এই দেশে। তাই ডাক্তার যদি তিনজন রোগী দেখে, নার্স সেবা করে ছয় জনের। আমি যার যেভাবে দরকার সেভাবে কথা বলতাম। রোগী এই এমপ্যাথি, এই সামান্য কিছু বিষয়ে সহানুভূতি চায়।

প্রতিটি রোগী আলাদা মানুষ। কেউ ধনী কেউ গরিব, কেউ নেতা কেউ লাইটম্যান। ধনী আশা করেন তার সাথেই গল্প করবে ডাক্তার। ডাক্তার তার সাথে গল্প করবে যার দরকার। এই লাইটম্যান দরিদ্রতম ছিলেন। তাকেই আমি সবচেয়ে বেশি সময় দিতাম। কারণ তার জন্য সেটা দরকার। তার অসুখ ভয়ংকর ছিল। বাঁচবেন কি না সেটা অনিশ্চিত ছিল। কিন্তু জীবনের শেষে এসে তিনি আমাদের ওয়ার্ডে আমাদের দেওয়ার সাধ্য অনুযায়ী সর্বোচ্চ যত্ন পেয়েছিলেন।

ধনী-দরিদ্র নয়, ক্ষমতাবান ক্ষমতাহীন নয়, ধর্ম নয়, জাতি নয়, শত্রু নয় মিত্র নয়, আগে যার যতটুকু সেবা দরকার সে ততটুকু পাবে। বিচার আচার করার কাজ ডাক্তারের না। তার কাজ মানুষের জীবনের যত্ন নেয়া। এটাই ছিল আমাদের সিনিয়রদের নির্দেশ ও উপদেশ।

সেই লাইটম্যান, তিনি মমতার মধ্যে এই পৃথিবী থেকে চলে গিয়েছিলেন। ডাক্তার কেবল মানুষকে বাঁচায় না তার মৃত্যুকেও সহজ ও কম কষ্টকর করে।

আমি খুব কৃতজ্ঞ যে আমি সারাজীবন সেরা চিকিৎসকদের আমার শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলাম। তারা কেবল আর শিক্ষক থাকেননি আমার বন্ধু ও ভাইবোনেও পরিণত হয়েছেন।

লেখক: চিকিৎসক ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব

ঢাকাটাইমস/১০নভেম্বর/এসকেএস

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফেসবুক কর্নার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :