একটি জাগরণের অপেক্ষায় বাংলাদেশ

অধ্যাপক ড. ফরিদ আহমেদ
  প্রকাশিত : ০৩ অক্টোবর ২০২১, ১৯:০৫
অ- অ+

অস্ট্রেলিয়ানদের কাছে স্যুটকেস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এখানে সকলেই একটি স্যুটকেস নিয়ে অভিবাসন করেছেন। যারা অভিবাসন করেন তাদের স্যুটকেস যত্নে থাকে। ভাঙলেও সেটি রিপিয়ার করে সঙ্গে রাখেন। কারণ সেটি একটি স্মৃতি! স্যুটকেস মায়েদেরও একটি প্রিয় স্মৃতি। বিয়ের পর যখন সংসার করতে স্বামীর বাড়ি যান তখন ওই স্যুটকেসটা নিয়ে নতুন সংসারে আসেন এবং বাবার বাড়ির স্মৃতি হিসেবে সেটি অনেক যত্ন করে রাখেন। সুটকেস নিয়ে আমাদের আছে অনেক অজানা আবেগময় কাহিনি।

এই স্যুটকেস বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। ১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হন। এর পরেই জিয়ার মহিমা বিবরণ দিতে ভাঙা স্যুটকেস ও ছেঁড়া গেঞ্জির কথা বলে জনগণের মনে ভালোবাসা সৃষ্টি করতে জিয়ার সৈনিকেরা উদ্যোগী হন। ২০০৭ সাল পর্যন্ত এটাই ছিল স্যুটকেস কাহিনি। এই স্যুটকেস আবার রাজনৈতিক নিপীড়নের হাতিয়ার হয়ে ওঠে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রীকে অপদস্থ করতে। তিনি নাকি এক স্যুটকেস ভর্তি করে সাড়ে তিন কোটি টাকা ঘুষ নিয়েছেন। এরপর এলো সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিষয়। তাকে যখন বিদেশ পাঠানো হচ্ছিল তখন নাকি তিনি ৪০টি স্যুটকেস নিয়ে যাত্রা করেছিলেন।

স্যুটকেস নিয়ে ধোঁয়াশা সেখানেই শেষ হলেও আবার মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিউ ইয়র্ক সফর নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সেখানেও এসেছে স্যুটকেস রাজনীতি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাদের উদ্দেশে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন- যেহেতু তারা স্যুটকেসগুলো দেখেছে, সেহেতু তারা যেন অনুসন্ধান করে বের করে সেগুলো কোথায় গেল।

সুনীল সপ্নীল অর্থনীতি আর জলবায়ু রাজনীতি বিশ্বে এক অফুরন্ত সম্ভাবনা ও উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। সুনীল অর্থনীতির সম্ভাবনাকে মাথায় রেখে বিভিন্ন দেশ ডুবোজাহাজ বা সাবমেরিন কেনার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। সেই প্রতিযোগিতা বিশ্ব রাজনীতিতে এক কঠিন সমস্যা সৃষ্টি করেছে। সম্প্রতিকালে ওয়েস্টার্ন নেশনস মনে করছে চীন একটি আগ্রাসী পরাশক্তি। তাকে মোকাবেলা একান্ত জরুরি। আর সেই চিন্তা থেকে জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য কোয়াড সামরিক জোট গঠন করেছে। এবং অস্ট্রেলিয়া যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাষ্ট্র অপর একটি জোট গঠন করেছে, যা পারমাণবিক সাবমেরিনকেদ্রিক। বাংলাদেশও সাবমেরিন কিনছে। আর সেই দেখাদেখি ভারতের অর্থে মিয়ানমার সাবমেরিন কিনেছে। এভাবে প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগর অঞ্চলে শুরু হয়েছে সুনীল অর্থনীতি সুরক্ষা প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতা থেকে যে উত্তাপ সৃষ্টি হচ্ছে তা আরেকটি যুদ্ধের দামামা বাজাচ্ছে। জলবায়ু রাজনীতি দিয়ে যেখানে সমগ্র পৃথিবীকে আবাসযোগ্য করা এবং পৃথিবীর প্রাণপ্রবাহ অবিরাম ও অনন্তকাল করবার চেষ্টা সেখানে সাবমেরিন রাজনীতি বিপদজনক।

অস্ট্রেলিয়া গড়ে উঠেছে অপরাধীদের সাজাকে কেন্দ্র করে। ব্রিটিশ সরকার জাহাজে করে অপরাধীদের নিয়ে আসে এবং গড়ে তোলে ব্রিটিশ কলোনি। এই কালিমার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের নিঃশেষ করে দেওয়ার নির্মমতা। সেই কালিমা মুছে অস্ট্রেলিয়া এগিয়ে যেতে চায়। কিন্তু এবার যেন সেই কালিমা আবার অস্ট্রেলিয়ার মুখখানি অন্ধকারে ফেলে দিচ্ছে। অস্ট্রেলিয়া ফ্রান্সের সঙ্গে আগেই সাবমেরিন কেনার একটি চুক্তি করেছিল। কিন্তু ফ্রান্সের অজান্তেই অস্ট্রেলিয়া একটি নতুন চুক্তি করে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে। ফলে অস্ট্রেলিয়াকে একটি অবিশ্বাসী জাতি হিসেবে মনে করতে শুরু করেছে বলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ম্যালকম টানবল মনে করেন।

এর আগেই সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ক্রিস্টিয়ান পটার ধর্ষণের অভিযোগে সরে যেতে বাধ্য হন। এবং সেই ধাক্কা না সামলাতেই তিনি আবার অজানা পক্ষ থেকে টাকা নিয়ে মামলার ফি প্রদান করেন। সত্য বেরিয়ে এলে তাকেও সরে যেতে হয়। এবং পক্ষকাল অতিক্রম না করতেই নিউ সাউথ ওয়েলস এর মুখ্যমন্ত্রী আজ পদত্যাগ করলেন এক বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের যবনিকাপাত ঘটিয়ে। নীল সাগরের পানি পান করলে এভাবে যে নীল হয়ে বিদায় নিতে হয় সেটা আমরা ভুলে যাই। মুখ্যমন্ত্রী নিজে কোনো টাকা নেননি। তিনি নিজের পরিবারের জন্য কিছু করেননি। তবে বন্ধু তথা বয়ফ্রেন্ডের জন্য কিছু করেছেন যা জনগণের আস্থা ভঙ্গের সামিল।

অনেকেই এই খবরটি পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বলছেন-যদি এমনটি বাংলাদেশে হতো! আসলে আমরা অনেক অনেক পিছিয়ে রাষ্ট্র পর্যায়ে সততার চর্চায়। জাতির অনেক স্বপ্ন আমরা পূরণ হতে দেখছি। কিন্তু দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। আমাদের গরিব কৃষক, আমাদের প্রবাসী শ্রমিক মানবেতর জীবন যাপন সুখের মুখ দেখবার স্বপ্নে দেশে টাকা পাঠায়। আর সেগুলোকে পুঁজি করে একশ্রেণির মানুষ ভোগ-বিলাসে লিপ্ত। একদিন হয়তো আবার বাঙালি জেগে উঠবে সেই সুনীল স্বপ্নে- আমাদের কষ্টের রাত শেষে সকাল হবে। সেই জাগরণের অপেক্ষায় বাংলাদেশ।

সাবেক ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধীদলের নেতা সকলেই পদত্যাগের কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য গ্ল্যাডিস বেরেজিক্লিয়ানকে স্বাগত জানিয়েছেন। এ এক বিরল সন্মান। জনগণের আস্থাতে সংকট সৃষ্টি করেও যে প্রশংসা পাওয়া যায় তা অভাবনীয়। আমরাও একদিন এমন শাসক পাবো সেই আশায় দিন গুনি যেভাবে রজকিনীর জন্য ১২ বছর অপেক্ষা করেছিল তার প্রেমিক চন্ডিদাস। একেই বলে জনগণের প্রতি প্রকৃত ভালোবাসা। একেই বলে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা। আমরাও একদিন পারব! এক নতুন ইতিহাস গড়লেন গ্ল্যাডিস বেরেজিক্লিয়ান। স্বাগতম গ্ল্যাডিস বেরেজিক্লিয়ান। তার মতো সাহসী নারী যেন যুগে যুগে জন্মে বিশ্বের প্রান্তে প্রান্তে। একেই বলে দেশপ্রেম। উজ্জ্বল হলো অস্ট্রেলিয়ার মুখমণ্ডল গ্ল্যাডিস বেরেজিক্লিয়ানের পদত্যাগে।

আমাদের দেশে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল পদ্মা ব্রিজকে কেন্দ্র করে। সেই সময় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী পদত্যাগ করেছিলেন। সেরকম দৃষ্টান্ত আর আমরা দেখিনি। ওই অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছিল বলে পরবর্তী সময়ে উত্থাপিত সকল অভিযোগকে ষড়যন্ত্র কিংবা মিথ্যা অভিযোগ হিসেবে নেওয়া হয়েছে। আমরা সম্মানিত মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে দুর্নীতির বিষয়ে বলতে শুনেছি, যেগুলো চলছে সেগুলো ডাকাতি। আমরা মন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্যের অভিযোগ শুনলাম কয়েকদিন আগে। আমাদের অনেক প্রকল্প আছে যার যৌক্তিকতাকে খণ্ডন করা যায়। কিন্তু সেগুলোর বিষয়ে কথা বললে সরকার বিরোধী হতে হয়।

করোনা মহামারিকে কেন্দ্র করে দুর্নীতির পাহাড়সম অভিযোগ এসেছে। কিন্তু সেগুলোর জন্য অদক্ষতা হিসেবে মন্ত্রীর পদত্যাগ আমরা দেখিনি। হয়তো মন্ত্রী নিজে দুর্নীতি করেন না। কিন্তু দুর্নীতি প্রতিরোধও মন্ত্রীর দায়িত্ব নয় কি? নেতৃত্ব মানে জনগণ আপনার কথা শুনবে। যদি আপনার আহ্বান জনগণ না শোনে তবে নেতৃত্বর ব্যর্থতার দায় নিয়ে পদত্যাগের ভার বহন কি কঠিন? একটু খারাপ লাগবে। কিন্তু পদত্যাগের ফলে যে মহান দৃষ্টান্ত স্থাপিত হলো তাও একপ্রকার দেশ সেবা, জনগণের সেবা। বলা হয় আমি চলে গেলে আরও খারাপ হবে। আদৌ কি তাই? যদি তাই হতো তবে গ্ল্যাডিস বেরেজিক্লিয়ান পদত্যাগ করতেন না। শুদ্ধ সমাজ, শুদ্ধ রাজনীতি, শুদ্ধ সরকার ব্যবস্থার যে দাবি সমাজ করে থাকে তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন দেশ সেবার অংশ হতে পারে। এজন্য প্রয়োজন জাগরণ- জনতা ও রাজনীতিবিদের চেতনা জাগরণ- শুদ্ধ রাজনীতির চেতনা জাগরণ। সেই জাগরণের অপেক্ষায় বাংলাদেশ। রাজনীতি হোক বাণিজ্য চিন্তামুক্ত জনকল্যাণের বাহন। আর রাজনীতিবিদ সেই বাহনের চালক। যেখানে ব্যক্তি, গোষ্ঠী, পরিবারের স্বার্থ হবে কোরবানি এবং জনস্বার্থ হবে প্রাণ। আমাদের এই স্বপ্ন সত্যি হবে একদিন।

লেখক: শিক্ষক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
নিজ স্বার্থে সীমান্তের ওপারে যোগাযোগ রাখবে বাংলাদেশ, কে কী বলল-যায় আসে না: নিরাপত্তা উপদেষ্টা
বাংলাদেশের হয়ে খেলতে ফিফার অনুমতি পেলেন সামিত সোম
এপ্রিলে ৫৬৭ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৫৮৩, শীর্ষে মোটরসাইকেল
সাবেক মন্ত্রী তাজুলসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা