সমীপে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী: শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল স্ট্রাটেজিক গত ১৫ তারিখ একটি সেমিনার আয়োজন করেছিল। সেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান। সেখানে নিয়োগ কর্তৃপক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে চাকরি প্রার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক হলেও তারা বাংলা, ইংরেজি জানে না। তারা কিভাবে কথা বলতে হয়, কিভাবে লিখতে হয়, কি আচরণ করা উচিত সে সব নিয়ে অভিযোগ উঠেছে।
আমরা পত্রিকাতে অভিযোগ শুনতে পাই যে, উচ্চতর গবেষণাতে চলছে ফাঁকিবাজি ও চুরি এবং সে সব অভিযোগ আমলে না নিয়ে উপাচার্য নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু কেন এমন অভিযোগ আমাদের শুনতে হচ্ছে? একটু অনুসন্ধান করলেই আমরা বুঝতে পারবো, কেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি স্বায়ত্তশাসনের দলিল মাত্র আছে। কিন্তু তাদের নেই অর্থ। সুতরাং, ওই অর্থ আসে সরকারের পক্ষ থেকে। তেমনি মাধ্যমিক ও প্রাথমিক শিক্ষার বাজেট আসে শিক্ষা থেকে। জনগণের কষ্টার্জিত অর্থের এমন দুর্দশা নাগরিকদেরকে ভাবনায় ফেলে দেয় এবং সরকারের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ করে নয় কি?
আমরা শুনতে পাই, শিক্ষক নিয়োগে চলে টাকার লেনদেন। ওই রকম একটি অনৈতিক ও বেআইনি ব্যবস্থা যদি প্রচল থাকে, তবে আমরা কোনোদিনই সরকারের প্রচেষ্টার সুফল পাবো না। নিয়োগ প্রক্রিয়ার অসচ্ছতা ও দুর্নীতি থেকে আমাদের মানুষ গড়ার কারিগর আসে বিধায় ভালো মানের শিক্ষক সমাজ পায় না। শিক্ষক ও মা যদি ভালো না হয় তবে কখনোই সুনাগরিক সৃষ্টি সম্ভব হয় না। যেসব ভালো মানুষ আমরা পাই তা ওই পরিবারের চেষ্টার ফলে সৃষ্টি হয়ে থাকে। নিয়োগ যেমন দুর্নীতির পথে হয়, তেমনি বদলি ও পদোন্নতিতে আছে দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি।
সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগের শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। আমরা বিভিন্ন সময় ছাত্রলীগকে দুর্বল প্রার্থী নিয়োগের তদবির করবার অভিযোগ পত্রিকায় দেখি। এবার সম্পূর্ণ ভিন্ন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ মেধাবীদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
বাংলাদেশ ছাত্রলীগ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে গড়া একটি সংগঠন। এই সংগঠনটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। আমাদের মুক্তির সংগ্রামে, জাতির পিতাকে আয়ুব খানের জেল থেকে মুক্ত করতে, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, গণতন্ত্রের মুক্তি এবং ১/১১’র অনৈতিক মাইনাস ফর্মুলাকে রুখে দিয়েছে। সুতরাং, তারা বিভিন্ন সময় অপপ্রচারের শিকার হয়ে থাকে। সংগঠনটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। সুতরাং, অভিযোগের তির সেদিকেও যায়।
শিক্ষার মান উন্নয়ন করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে আমরা বিএনপির আমলে ‘মিলন পাশের’ কথা শুনেছি। সেই করুন দশা থেকে উত্তরণের প্রত্যাশায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসিয়েছে জনগণ। বিগত ১৪ বছর সরকার অভূতপূর্ব উন্নয়ন করলেও শিক্ষার মান উন্নত হয়নি কেন তা অনুসন্ধান করা একান্ত জরুরি। একসময় প্রশ্ন ফাঁস সরকারকে বিব্রত করেছে। আপনার নেতৃত্বে সেটা বন্ধ হয়েছে।
শিক্ষার মান উন্নয়নে নৈতিকতা অন্যতম। শিক্ষককে হতে হবে উন্নত নৈতিক চরিত্রের অধিকারী। দুর্ভাগ্য আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের যে কদর্য চেহারা আমরা দেখছি তা শিক্ষক হয়ে আমার লিখতেও বিবেকে বাঁধছে। অতীতে আমরা নিয়োগ নিয়ে উপাচার্যকে দুষেছি। কিন্তু এবার উপাচার্য ধর্ষক। উপাচার্য নারী নির্যাতনকারী।
মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী, সম্প্রতি আপনি গুচ্ছ বাস্তবায়নে অবস্থান নিয়েছেন। কিন্তু ওই গুচ্ছ আমাদেরকে ভালো মানের শিক্ষার্থী দিতে ব্যর্থ হচ্ছে বলে প্রমাণ মিলেছে। ওই গুচ্ছতে যেমন MCQ পদ্বতি ব্যবহার করা হয় তেমনি MCQ পদ্ধতি চালু আছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে। ফলে শিক্ষার মান কমছে। এখন হাতের আঙ্গুল দেখিয়ে ক, খ, গ, ঘ, উত্তরে টিক দেয়া যায়। ফলে নকল করে পাস করা ছাত্র MCQ পদ্ধতির ভর্তির প্রশ্ন পেয়ে ওই একই পন্থায় পাস করে।
এভাবেই ধস নেমে আসে শিক্ষায়। আমার অভিমত হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষকদের সঙ্গে মুখোমুখি অবস্থানে না দাঁড়িয়ে শিক্ষার মান উন্নয়নে সরকারকে ভাবতে হবে। শিক্ষার মান উন্নয়নে সরকার চিন্তা করেছিল বিদেশ থেকে শিক্ষক আনবার।আমরা দেখেছি বিমানকে লাভজনক করবার প্রত্যাশায় বিদেশ থেকে এমডি নিয়োগ দেয়া হয়েছিল।
বিদেশ থেকে শিক্ষক নিয়ে আসার বিষয়ে আমরা প্রতিবাদ করেছি। আমরা বলেছি আমাদের মাঝে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি করা ভালো শিক্ষক আছে। তাদেরকে প্রধান শিক্ষক, উপাচার্য, ডিন, প্রভোস্ট হিসেবে নিয়োগ দিন। তাদেরকে কাজ করবার সুযোগ করে দিন। শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় ও পরিকল্পনায় তাদেরকে সংযুক্ত করলে কাঙ্ক্ষিত সুফল পাবেন।
সেজন্য একটি তালিকা তৈরি একান্ত প্রয়োজন এবং তাদের সঙ্গে প্রতি সপ্তাহে আলোচনা ও মূলায়নে বসা একান্ত জরুরি। যে সব উপাচার্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে সেগুলো অনুসন্ধান করলে সত্য বেরিয়ে আসবে। একটি মহল এখন বলবে, আগামী নির্বাচনের আগে এখানে হাত না দিতে। আমাদের কাছে মনে হয় অপেক্ষা করা ভুল হবে। শিক্ষা প্রশাসন যদি সৎ মানুষদেরকে নিয়ে সাজানো হয় তবে সুফল আসবেই।
আপনি হয়তো লক্ষ্য করেছেন, বাংলাদেশের সেনাবাহিনী, পুলিশ বাহিনী বিদেশে আন্তর্জাতিক মানের সেবা প্রদান করছে। আমাদের কর্মীরা বিদেশিদের কাছে উপযুক্ত প্রমাণ করছে। সুতরাং, শিক্ষাকে যদি আমরা শক্ত নাবিকের হাতে তুলে দিতে পারি, তবেই আমাদের মুক্তি আসবে। আমাদের সমাজে যারা সরকারের উন্নয়ন দেখতে পায় না তাদেরকে উন্নয়ন দেখাতে পারে শিক্ষা এবং সেখানে আপনার ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
আপনি মেধাবী ও দেশে-বিদেশে ভালো প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনাকে সেজন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করবার সুযোগ দিয়েছেন। সুতরাং জাতি আপনার কাছে অনেক বেশি প্রত্যাশা করে অন্য সব মন্ত্রী থেকে। আমাদের শিক্ষকদের যে স্বাধীনতা আছে তা যেন কেউ অপব্যবহার না করতে পারে সেজন্য সরকারকে সজাগ থাকতে হবে।
আমলারা বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে নিয়ন্ত্রণ করতে চান। তাদেরকে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে দূরে রাখার ব্যবস্থাও আপনার সাফল্যের চাবিকাঠি হতে পারে। আমাদের TNO সাহেবও দাবি করেন, তিনি সরকারের প্রতিনিধি। সুতরাং তাকে প্রধান করতে হবে। আমাদের জেলা প্রশাসকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটে বসতে চান। তাদের অনেকেই এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধাক্ষ। বিভিন্ন কমিশন এখন অবসরের পর আমলাদের বিনোদন কেন্দ্র।
বরেণ্য এক শিক্ষক-অধ্যাপক বলেছেন, যেদিকে তাকাই আমি প্রশাসক দেখি। সেবার মানসিকতা সম্পন্ন সরকারি কর্মকর্তা -কর্মচারীদেরকে আমরা আমলা বলছি না কিন্তু! তাদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা আছে। শিক্ষা প্রশাসন নয়, শিক্ষা একটি সেবা এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় সেই বিবেচনায় সেবা বিভাগ। আমাদের মাঝে সেবার মনোভাবের যে অভাব দেখা দিয়েছে তা ওই শিক্ষার দুর্বলতা থেকে। সেই দুর্বলতা কাটিয়ে আমরা যেন স্মার্ট বাংলাদেশ অর্জন করতে পারি, সেই প্রত্যাশা জাতি আপনার কাছে আকুলভাবে ব্যক্ত করছে।
লেখক: শিক্ষক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।