আমি ঝুলছি দেখ

অয়েজুল হক
 | প্রকাশিত : ০৫ নভেম্বর ২০১৬, ২২:৪৯

এমনিতেই অভাবের সংসার। নুন আনতে পানতা ফুরায়। এর ওপর আবার লোন আর সুদের বোঝা ঘাড়ে চেপেছে। প্রতিদিন সমিতির লোকেরা আসছে। এসব কে বুঝেছিল প্রথম! টাকা সঞ্চয় করবে ভেবে ওদের প্রলোভনে পড়ে সমিতিতে নাম লিখিয়েছিল সিমি। স্বামীকে বলেনি। শুনলে স্বামী বুঝবে না। ও একটা গাধা। এতো লাভ কেউ ছাড়ে? সিমিও ছাড়েনি। সবুজ নামের ছেলেটা দেখতে দারুণ স্মার্ট। কী সুন্দর চেহারা। চেহারায় মায়া আছে।

মমতা আপার সাথে প্রথম এসেছিল ওদের বাড়িতে। সিমিকে দেখেই হাসে। কেমন আছেন ভাবী? যেন কতোদিন ধরে সিমির সাথে ওর পরিচয়। সিমিও হাসে। সবুজের চোখে চোখ রেখে বলে, ভালো আছি। কথাটা মুখ দিয়ে বললেও সিমি জানে কথাটা সঠিক নয়। ও ভালো নেই। ছোট ছোট তিনটে বাচ্চা। রিকশাওয়ালা স্বামী। তিনবেলা ভাত খেলেও সংসারে সুখ নেই। স্বচ্ছলতা নেই। পাশের রুমে যে ভাড়া থাকে ওর স্বামীও রিকশা চালায়। কিন্তু ওদের ঘরে কতোকিছু। কালার টিভি আছে। সিডি আছে। কি সুখ নিয়ে বউটা সারাদিন সিনেমা দেখে। সিমি যদিও মাঝে মাঝে যায় কিন্তু ছেলে-মেয়ে তিনটার জ্বালায় মন ভরে দেখতে পারে না। ও বাড়ির বউটার স্বভাব ভালো না। কেমন খ্যা খ্যা করে। রিকশাওয়ালার বউয়ের মেজাজ কতো! ‘আমরা এসেছিলাম একটা কাজে।' কথা বলে মমতা। ‘যদিও কাজটা আপনার নিজেরই।'

মমতা পাশের এলাকায় থাকে। লেখাপড়া জানা মেয়ে। এখন সমিতিতে চাকরি করে। সবুজ ভাইয়ের সাথে ওর বিয়ে না হলেও ওদের বেশ মিল। সারাদিন একসাথে মোটর সাইকেলে ঘুরে বেড়ায়। একসাথে কী সুন্দর করে হাসে। সিমির হিংসা হয়। ওদের স্বামী-স্ত্রীর মাঝেও এতো মিল নেই। ‘আপা কী যেন বলছিলেন?' প্রশ্ন করে সিমি। ‘আমাদের সমিতির নাম তো শুনেছেন?' কথা বলে মমতা।

‘জ্বি, সূর্যমুখী সমিতি।'

‘হ্যাঁ। আমাদের সমিতিতে আপনিও নাম লেখাবেন। দশ, বিশ, পঞ্চাশ যা খুশি সপ্তাহে জমা করতে পারেন। বছর শেষে দেখবেন আপনার অনেক টাকা জমা হয়ে গেছে। আর আমারা যা লাভ দেই তা শুনলে তো অবাকই হবেন আপনি।'

মমতার কথা শুনে সমিতিতে নাম লেখাতে সাধ জাগে সিমির। বছর শেষে লাভসহ টাকাটা দিয়ে একটা সিডি কিনতে পারবে। কিন্তু ওর স্বামী যে দজ্জাল। শুনলে মেরেই ফেলবে। বলবে, ভাত খেতে পারে না আবার সমিতি। চিন্তায় পড়ে যায় মেয়েটা। সিমিকে দেখেই যেন সব বোঝে সবুজ। বলে, ‘ভাবী, স্বামীর কথা ভাবছেন? দুশ্চিন্তা করবেন না, সংসারের সামান্য টাকা বাঁচিয়ে আপনি সমিতি চালাতে পারবেন। দেখবেন আপনার একটুও কষ্ট হবে না। মাঝখান দিয়ে আপনার অনেক টাকা জমা হয়ে যাবে। টাকার তো সবার দরকার তাই না?'

সিমি নীরবে মাথা নাড়ে। সবুজের কথাটা ফেলতে পারে না। সমিতিতে নাম লেখায়। দু'সপ্তাহ পরেই বুঝতে পারে যতো সহজ ভেবেছিল ব্যাপারটা ঠিক অতো সহজ নয়। গরিব মানুষের পক্ষে নিয়মিত পঞ্চাশ-একশো টাকা প্রতি সপ্তাহে জমা করা খুব কঠিন। সিমির চাউল বিক্রি করতে হয়। স্বামীর পকেট থেকে টাকা চুরি করতে হয়। স্বামী মানুষটা বুঝলেই চিল্লাপাল্লা শুরু করে।

‘এই আমার পকেট থেকে টাকা নিছিস?'

‘না।' মিথ্যা জবাব দেয় সিমি।

‘তাইলে টাকা গেল কই?' খেকিয়ে ওঠে সিমির বর।

‘তার আমি কি জানি?'

প্রথম দিকে রাগে গরগর করতো, কিছু বলতো না। কয়েকবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়ায় স্বামী একদিন আচ্ছামতো মার দেয়। কতোকিছু বলে। সিমি নীরবে সহ্য করে না। সেও হাত পা চালায়। পুরুষ মানুষটার সাথে পেরে ওঠে না। এভাবে আর চালানো যায় না।

একদিন সবুজ ভাইকে বলে, ‘আমি সমিতির টাকা তুলে নেব।' সবুজ অবাক হয়। ‘কেন ভাবী!' ‘সমস্যা হচ্ছে ভাই। অশান্তিতে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছি।' জবাব দেয় সিমি। ‘আপনি এক কাজ করুন, হাজার তিনেক টাকা লোন নেন। সেই টাকা দিয়ে সমস্যা কাটিয়ে ওঠেন। আস্তে আস্তে জমার টাকার সাথে লোনের টাকাও পরিশোধ করে দেবেন।' পরার্মশ দেয় সবুজ। টাকার কথা শুনে সিমির মুখটা আনন্দে ভরে ওঠে। তিন হাজার টাকা! সিমি কোনোদিন একসাথে অতোগুলো টাকা ছোঁয়নি। এতো টাকা পেলে মেয়েটা কী করবে! বাপের বাড়ি যাবে। ওকে না বলেই যাবে। ভালো দেখে দুটো শাড়ি কিনবে। কোনোদিন ওর স্বামী ওকে একটা ভালো শাড়ি কিনে দেয়নি। অবশ্য কিছু টাকা রেখে দেবে কিস্তি দেবার জন্য। সিমি আর একটা কাজ করতে পারে, নিজেকে বলে। সেলইয়ের কাজ শিখতে পারে। তখন ও নিজেই কিছু টাকা রোজগার করতে পারবে।

এসব সাত-পাঁচ ভেবে শেষ পর্যন্ত সোৎসাহে বলে, ‘ঠিক আছে, আপনি লোনের ব্যবস্থা করেন সবুজ ভাই।'

পরদিন কিছু কাগজপত্র নিয়ে সবুজ আর মমতা আসে। অনেকগুলো টিপ সই দিয়ে সিমি তিন হাজার টাকা নেয়। খুব আনন্দ লাগে সিমির। দু'দিন বাদেই স্বামীর কাছে বাপের বাড়ি যাবার বায়না ধরে। স্বামী যেতে দিতে নারাজ, তবুও যাবে সিমি। এক প্রকার জোর করেই চলে যায়। কিছুদিন বেশ আনন্দে কাটে সিমির। বেশ মজায়। পরর্বতী মাসে কিস্তি দেবার সময় আসে। টাকা দিতে গিয়ে অবাক হয় সিমি! শুধু সুদ দিতে হবে প্রতি মাসে একশত টাকা। তিন হাজার টাকায় প্রতিমাসে একশত টাকা সুদ তাও নাকি কম। সবুজ ভাইয়ের কাছে অনেক কাকুতি মিনতি করে সিমি। বলে, ‘ভাই আমার সুদের টাকাটা মাপ করেন, কম করেন।'

সবুজ বলে, ‘আমার কিছু করার নেই। আমি কী করবো?' এ যেন অন্য মানুষ। টাকা দেবে কিভাবে সিমি! কয়েক মাস টাকা দেবার পর আর টাকা দিতে পারে না। মমতা আর সবুজ ঘনঘন আসে। দিনে রাতে আসে। এক মাস টাকা না দিলে সুদের টাকা আরও বেড়ে যায়। হঠাৎ একদিন সুন্দর বুলির মানুষ সবুজের আচরণ পরির্বতন হয়। খুব ভোর বেলা আসে।

‘কী ব্যাপার আপনি তিন মাস টাকা দেন না কেন?' সিমির স্বামী ঘরে শোয়া। ভয় পায় সিমি। সবুজের পা জড়িয়ে ধরে। কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলে, ‘ভাই আমার স্বামী ঘরে শোয়া। এখন যান, আমি পরে কথা বলবো।'

সবুজের চোখ দুটো লাল হয়। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে, ‘যাব মানে? আপনি এক্ষুণি টাকা বের করেন। না হলে আপনার স্বামী-সন্তানসহ আপনাকে পুলিশে ধরিয়ে দেব।'

সিমির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। গুমড়ে কাঁদে। ওর কান্না শুনে স্বামী মানুষটা বেরিয়ে আসে। বউকে কাঁদতে দেখে বলে, ‘কী হয়েছে রে সিমি?' সিমি কথা বলে না। কথা বলে ভদ্রবেশী সবুজ। ‘আপনার স্ত্রী আমাদের সমিতি থেকে লোন নিয়েছে। অনেক মাস হলো টাকা পরিশোধ করছে না।'

সিমির স্বামী অবাক হয়। সিমির দিকে তাকিয়ে রুক্ষ কণ্ঠে বলে, ‘কিরে তাই নাকি?' নিরুত্তর সিমি।স্বামী যখন বুঝতে পারে ঘটনাটা সত্য তখন আর নিজেকে সামলাতে পারে না। সিমিকে আঘাত করে। ওর মাথা, মুখ আর পিঠে। সিমি নীরবে মার খায়। একটা শব্দও তার মুখ থেকে বের হয় না। ব্যাথার শব্দও না। সিমিকে মারার পর ওই লোকের সাথেও ঝগড়া হয়।

‘আমি ভাই কিছু জানি না। ভাত খেতে পারি না সুদের টাকা দেব কিভাবে?' সবুজ বিদ্রুপের হাসি হাসে। বলে, বউকে ঠিক রাখতে পারেন না আবার উল্টোপাল্টা কথা বলছেন? টাকা ঠিকই দেবেন, পুলিশে যখন পাছার উপর ক'ঘা দেবে তখন দেবেন। তার আগে দেবেন কেন।'

সবুজ চলে যায়। সিমির স্বামী অনেক সময় কালো মুখে বারান্দায় বসে থাকে। তারপর ভাঙ্গা রিকশাটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। স্বামী চলে যেতেই তিনটা বাচ্চা কোলে নিয়ে সিমি পুকুর পাড়ে যায়। সিমিদের বাসার পশ্চিম পাশের বাঁশ বাগানের ভেতর একটা ছোট পুকুর। পুকুরের পাশে বড় একটা আম গাছ। সবচেয়ে বড় ছেলেটা রিফাত। পাঁচ বছরের ছেলেটাকে প্রথম পানির মধ্যে ডুবিয়ে দেয় সিমি। শক্ত করে চেপে রাখে। ওর ছেলেটার বেশ শক্তি হয়েছে। অনেক সময় পানির মধ্যে শ্বাস নিতে না পেরে দাপাদাপি করে। রিফাত নিস্তেজ হয়ে যাবার পর দুই বছর আর ছয় মাসের মেয়ে সানজিদা ও মিথিকে পানিতে চুবিয়ে মারে। তিনটি সন্তানকে পানিতে রেখে সিমি আম গাছে ওঠে। সেই কতোদিন গাছে ওঠে না সিমি। ছোটবেলায় বান্ধবীদের সাথে নিয়ে কতোই না আম গাছ, জাম গাছ, এক ডাল থেকে আর এক ডাল করে বেড়িয়েছে। গাছে উঠে ওড়নায় ফাঁস দিয়ে ঝুলে পড়ে। একবারও ভাবে না একটা লক্ষ্য উদ্দেশ্য দিয়ে প্রভু তাকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। ভাবে না কোথায় যাবে সে! তার কী হবে। জীবন যে সৃষ্টি করতে পারে না জীবন ধ্বংস করার অধিকার তাকে কে দিলো?

সিমি ঝোলে। কয়েকবার লাফ দেয়। প্রতিটি ঝাঁকুনিতে সারা শরীর কেঁপে কেঁপে ওঠে। জিহবাটা বেরিয়ে আসে। কষ্টের তীব্রতায় চোখ দুটো কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। কী বীভৎস সিমি, দক্ষিণা বাতাসে দোল খায় একটা লাশ। উস্কোখুস্কো চুলগুলো বাতাসে ওড়ে। ঘূর্ণিঝড়ে পাক খাওয়া পাতার মতো। বিকালের দিকে গ্রামের মানুষ সিমির ঝুলে থাকার কথা জানতে পারে। দলে দলে মানুষ সিমিকে দেখতে আসে। মানুষের দল সারা বাগানটাকে ঘিরে ফেলে। ভরে যায়। ওর তিনটি বাচ্চাকে পুকুর থেকে তুলে আম গাছের নিচে শুইয়ে দেয়। ওপরে ওদের মা। ঝুলছে। সিমি যেন নিঃশব্দে বলছে, সুদের টাকা নিবি না! আমি ঝুলছি দেখ।

লেখক: গল্পকার

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :