দেশি চ্যানেলে বিদেশি সিরিয়াল বন্ধের দাবি কোন যুক্তিতে?

স্বকৃত নোমান
  প্রকাশিত : ০১ ডিসেম্বর ২০১৬, ১২:২৫
অ- অ+

বাংলাদেশের সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন বিদেশি সিরিয়াল বন্ধের দাবিতে এবার একজোট হলেন শিল্পী-কলাকুশলীরা। তারা বলছেন, কম টাকায় আমদানি করা এসব ডাবিং করা সিরিয়াল বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতায় ভীষণ বেমানান। ৩০ নভেম্বর সকালে জাতীয় শহীদ মিনারে ‘শিল্পে বাঁচি, শিল্প বাছাই’ স্লোগান নিয়ে একজোট হয়ে এই দাবি জানান তারা। ফেডারেশন অব টেলিভিশন প্রফেশনালস অর্গানাইজেশনের (এফটিপিও) ব্যানারে এই সমাবেশে বিদেশি ডাবিং করা সিরিয়াল প্রচার বন্ধ ছাড়াও চারটি দাবি জানাচ্ছেন শিল্পী-কলাকুশলীরা। ―সংবাদসূত্র : ঢাকাটাইমস২৪.কম

দেশি টিভি চ্যানেলে ডাবিংকৃত বিদেশি সিরিয়াল বন্ধের দাবি জানিয়েছেন টিভি নাটক সংশ্লিষ্টরা। এই ‘শিশুসুলভ’ দাবি কেন, কোন স্বার্থে—বিস্তর চিন্তা-ভাবনা করেও বুঝে আসছে না।

বাংলায় ডাবিংকৃত টিভি সিরিয়ালের জনপ্রিয়তা নিয়ে ব্যক্তিগত দুটি অভিজ্ঞতার কথা লিখে মূল প্রসঙ্গে যাব। আশির দশকের শেষ কি নব্বই দশকের শুরুর কথা। দক্ষিণ ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী আমাদের অজপাড়া গ্রামে তখন টেলিভিশনের সংখ্যা ছিল হাতেগোনা। পুরো গ্রামে বড়জোর তিন কি চারটি। গ্রামে বিদ্যুৎ ছিল না, উপজেলা সদর থেকে ব্যাটারি চার্জ করিয়ে তারপর টিভি চালানো হতো। সপ্তাহের শুক্রবার বিটিভিতে প্রচারিত হতো ‘আলিফ লায়লা’। সারা গ্রামের প্রায় অর্ধেক নারী-পুরুষ-শিশু এসে জড়ো হতো টিভিঅলা ঐ তিন-চার বাড়িতে, আলিফ লায়লা দেখতে। আধা ঘণ্টার এই অনুষ্ঠানটি দেখার জন্য জনপ্রতি দর্শককে দিতে হতো দুই টাকা করে। কেউ টাকা দিতে আপত্তি করত না। কেন করবে? ব্যাটারি চার্জ করাতে কি টাকা লাগে না? একবার চার্জ করাতে গেলে কমপক্ষে দশ টাকা লাগে।

আমি ছিলাম ঐ সিরিয়ালের একজন মুগ্ধ দর্শক। বাড়ির সবাইকে ফাঁকি দিয়ে সাপখোপে ভরা ছনখোলা পেরিয়ে জমিনে নেমে, জমিনের আলপথ ধরে রুদ্ধশ্বাসে দৌড়ে চলে যেতাম টিভিঅলা করিম মিয়ার বাড়িতে। খড়ের গাদার আড়ালে লুকিয়ে, করিম মিয়া বা তার পরিজনদের কেউ যাতে আমাকে দেখতে না পায়, সিরিয়ালটি দেখতাম। কারণ টিভিঅলাকে দুই টাকা দেওয়ার সামর্থ্য আমার নেই। সপ্তাহ-দশ দিনেও একবার দুই টাকা চোখে দেখি না। টাকা আমি দেব কোত্থেকে? তাই লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা।

বিটিভিতে যদি অনুষ্ঠানটি প্রচার না হতো, এই বিশাল আকারের ‘দ্য এরাবিয়ান নাইটস’ বা আরব্য রজনীর গল্পগুলো একজীবনে পড়ে হয়ত শেষ করতে পারতাম না। আলিফ লায়লা শেষ হওয়ার পর বিটিভিতে শুরু হলো ‘সিন্দবাদ’। বাড়ির পাশের রেল স্টেশনে একটি চা দোকান ছিল। এমাম মিয়ার চা দোকান। একটা সাদাকালো টিভি ছিল ঐ দোকানে। ঐ টিভিতে বন্ধুরা মিলে সিন্দবাদ দেখতাম। শুধু আমি বা আমার বন্ধুরা নয়, গ্রামের প্রায় শ খানেক মানুষ জড়ো হতো সিন্দবাদ দেখতে।

আমার এক বাল্যবন্ধু আমান। বর্তমানে দুবাইপ্রবাসী। সে ছিল সিন্দবাদের মুগ্ধ দর্শক। দরকার হলে ভাত খাবে না, ঘুমাবে না―কিন্তু সিন্দবাদ তার দেখা চাই। একদিন রাত আটটার সংবাদের পর সিন্দবাদ শুরু হলো। আমি দশ মিনিট আগে গিয়ে দোকানে হাজির। আমান তখনো বাড়িতে ভাত খেতে বসেছে, এমন সময় শুরু হয়ে গেল সিন্দবাদ। শুরু হওয়ার আগে একটা টাইটেল সঙ বাজত। সেটি শুনে আমান কি আর বাড়িতে বসে থাকতে পারে? পাতের ভাত পাতে রেখে রসুইঘর থেকে বেরিয়ে ধানকাটা জমিন ধরে দিল কা-িছেঁড়া দৌড়। জমিনের মাঝখানে পোঁতা ছিল লম্বা একটা রেল লাইন। অন্ধকারে দৌড়াতে গিয়ে সেটির সঙ্গে সে খেল প্রচ- ধাক্কা। তার নাক গেলে ফেটে, দুটো দাঁত গেল ভেঙে। শেষপর্যন্ত আমান ঐ অবস্থায় সিন্দবাদ দেখেছিল, নাকি বাড়ি ফিরে গিয়েছিল―একথা এতদিনে আর মনে নেই।

এই দুটি সিরিয়াল ছিল বাংলায় ডাবিংকৃত। সিরিয়াল দুটি ছাড়াও আমাদের শৈশব-কৈশোরে আরো তিনটি সিরিয়াল প্রচার হয়েছিল বিটিভিতে―রবিন হুড, দ্য সোর্ড অব টিপু সুলতান ও হাতেম তাঈ। আমি ছিলাম প্রতিটি সিরিয়ালের নিয়মিত দর্শক। ঐ সিরিয়াল দেখা ছিল বলেই টিপু সুলতানের ইতিহাস, সুলতান সুলেমানের ইতিহাস আমি এখন সহজে বুঝতে পারি।

এতক্ষণ ভূমিকা গেল। এবার মূল প্রসঙ্গে আসি। আগেই বলেছি, বাংলাদেশের বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে বিদেশি সিরিয়াল ও অনুষ্ঠান সম্প্রচার বন্ধের দাবিতে টিভি নাটক সংশ্লিষ্ট ১২টি সংগঠনের সদস্যরা এবার নতুন এক প্ল্যাটফর্মে এসে আন্দোলন শুরু করছে। গত ৩০ নভেম্বর বুধবার তারা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে একটি সমাবেশ করে পাঁচটি দাবি দিয়েছেন। পাঁচটির মধ্যে একটি হচ্ছে, ‘দেশের বেসরকারি চ্যানেলে বাংলায় ডাব করা বিদেশি সিরিয়াল/অনুষ্ঠান বন্ধ করতে হবে।’ তাদের বাকি চারটি দাবি নিয়ে আপাতত কোনো মন্তব্য না করি। কিন্তু তাদের উল্লিখিত দাবি সম্পর্কে আমার আপত্তি আছে। কেন বিদেশি সিরিয়াল বন্ধ করতে হবে? কোন যুক্তিতে?

শহীদ মিনারের ঐ সমাবেশে একজন বিশিষ্ট সংস্কৃতজন বলেছেন, ‘এসব বিদেশি সিরিয়াল আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে যায় না, তাই এগুলো বন্ধ করতে হবে।’ তার এই মন্তব্যটা খুবই শিশুসুলভ মনে হয়েছে। আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে কত কিছুই তো যায় না। আমরা যে প্যান্ট পরি, শার্ট গায়ে দেই, স্যু পরি, টাই পরি, চিপস খাই, নুডলস খাই, বার্গার খাই―এগুলো কি আমাদের সংস্কৃতি। কোনো কালে ছিল? আমরা যে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার বাংলা অনুবাদকৃত বই পড়ি, সেসব বই কি আমাদের সংস্কৃতির? অবশ্যই না। তাহলে আমরা কেন পড়ি? আমাদের সংস্কৃতিসম্ভূত নয় বলে কি আমরা বিদেশি সাহিত্য পড়া বাদ দিয়ে দেব? অবশ্যই না। বিদেশি টিভি দেখা বাদ দেব? বিদেশি সংবাদপত্র পড়া বাদ দেব? অবশ্যই না। এই যে আমরা এখন ফেসবুক ব্যবহার করি, এটাও তো আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে যায় না। তাই বলে আমরা ফেসবুক বা টুইটার ব্যবহার করা বাদ দেব? তাহলে বিদেশি সিরিয়াল প্রচার কেন বন্ধ করতে হবে?

অবশ্যই বন্ধ করতে হবে, যদি প্রচারিত এসব সিরিয়াল আমাদের সমাজে কোনো অস্থিরতা বা দর্শকদের মধ্যে কোনো নেতিবাচকতা তৈরি করে। বর্তমানে পাঁচটি বেসরকারি টেলিভিশনে মোট ছয়টি বিদেশি সিরিয়াল প্রচারিত হচ্ছে : মাছরাঙায় ‘দ্য সোর্ড অব টিপু সুলতান’, দীপ্ত টিভিতে ‘সুলতান সোলেমান’, আরটিভিতে ‘সিনড্রেলার বোন’, গাজী টিভিতে ‘আলিফ লায়লা’, একুশে টিভিতে ‘সীমান্তের সুলতান’ ও ‘হাতিম’। এসএ টিভিতে আসতে যাচ্ছে ‘ইউসুফ জোলেখা’।

বাংলায় ডাবিংকৃত এই ছয়টি টিভি সিরিয়াল দেখে দেশের মানুষের মধ্যে নেতিবাচক কোনো প্রভাব পড়ছে কি না? আমার মনে হয় না পড়ছে। এসব সিরিয়ালের মাধ্যমে মানুষ বরং ইতিহাস ও বিদেশি সংস্কৃতির নানা কিছু জানতে পারছে সহজে। তাহলে এগুলো বন্ধ করতে হবে কেন?

বাংলায় ডাবিংকৃত বিদেশি সিরিয়াল আরো বেশি করে প্রচার করা উচিত বলে মনে করি। ভারতের বিখ্যাত মহাকাব্য ‘মহাভারতে’র কাহিনি অবলম্বনে একটি সিরিয়াল ভারতের কোনো একটা টেলিভিশনে প্রচারিত হয়। আমি মনে করি এটি বাংলাদেশেও প্রচার হওয়া উচিত। রামায়ণের কাহিনি অবলম্বনে যদি কোনো সিরিয়াল তৈরি হয়, সেটিও প্রচার করা উচিত। প্রাচীন গ্রিক মহাকাব্য ‘ইলিয়াড’, ‘অডিসি’র কোনো সিরিয়াল হয়েছে কি না জানি না। হলে বাংলায় ডাবিং করে এগুলো প্রচার করা দরকার। পারস্যের মহাকবি ফেরদৌসির শাহনামা নিয়ে সিরিয়াল হয়েছে, যতটা জানি। আশা করি আমাদের বেসরকারি চ্যানেলগুলো শাহনামা ডাবিং করে প্রচার শুরু করবে। এই আকাশ সংস্কৃতিরকালে সমাজের জন্য খারাপ নয় এমন কোনো সিরিয়াল বন্ধ করার পক্ষে আমি নই। টেলিভিশনে না হয় বন্ধ করলেন, কিন্তু ইউটিউবে তো আছে। নাকি ইউটিউবও বন্ধ করে দিতে হবে? বন্ধ করে দেওয়ার দাবি কূপম-ূকতা বই আর কিছু নয়।

রবীন্দ্রনাথে বাণী দিয়ে শেষ করি : “দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে/যাবে না ফিরে/এই ভারতের মহামানবের/সাগরতীরে।/...তারা মোর মাঝে সবাই বিরাজে/কেহ নহে নহে দূর/আমার শোণিতে রয়েছে ধ্বনিতে/তারি বিচিত্র সুর।” হ্যাঁ, আপনারা বলতে পারেন, আমরা তো শুধু নেই, আমাদের কিছু তো ওরা নেয় না। এই যুক্তি আমি মানতে রাজি নই। আপনারা সেইরকম একটা সিরিয়াল বানান। দেখবেন আপনাদের সিরিয়াল বিভিন্ন ভাষায় ডাবিং হয়ে বিভিন্ন দেশে প্রচারিত হচ্ছে। সিরিয়াল বানানোর মতো কাহিনি কি আমাদের নেই? অবশ্যই আছে। মনসামঙ্গল, পদ্মাবতী, মেঘদূত বা ময়মনসিংহ গীতিকার কাহিনিগুলো নিয়ে সিরিয়াল তৈরি করে দেখুন, বিশ্বজুড়ে কেমন সাড়া পড়ে যায়। আপনারা তা করবেন না। তা পারবেনও না। হয়ত পারবেন, কিন্তু আপনাদের প্রতিভাকে আপনারা ব্যবহার করতে অনিচ্ছুক। কারণ আপনারা শর্টকাট শিল্প করতে চান। এই শর্টকাট শিল্প বিশ্বের কেউ নেবে না। এই না পারাটা আপনাদের দৈন্য। আপনাদের ব্যর্থতা। আপনাদের দৈন্য আর ব্যর্থতা ঢাকবার জন্য দয়া করে বিদেশি সিরিয়াল বন্ধের দাবি জানিয়ে প্রজন্মকে কূপম-ূকতার দিকে ঠেলে দেবেন না।

স্বকৃত নোমান : সহযোগী সম্পাদক, সাপ্তাহিক এই সময়

ঢাকাটাইমস/১ডিসেম্বর/এসএন/টিএমএইচ

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
উপজেলা বিএনপি সভাপতির নির্দেশে ঢাবি ছাত্রদল নেতাকে গ্রেপ্তারের অভিযোগ
কমিউনিটি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের ৬৮তম সভা অনুষ্ঠিত
সিলেটের সাদা পাথর লুটের ঘটনায় সিআইডির অনুসন্ধান শুরু
ডাকসুর চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ: প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সর্বমোট ৪৭১ জন প্রার্থী
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা