ওয়েস্টার্ন সবজি চাষে ভাগ্যবদল
দেশের মাটিতে ওয়েস্টার্র্ন সবজি চাষ হবে, আর তা বিক্রি করে ঘরে উঠবে লাভ, এমনটা কল্পনাও করেনি এলাকার মানুষ। কিন্তু গ্রামীণ কৃষিতে ওয়েস্টার্ন সবজি চাষ করে একরকম বিপ্লব ঘটিয়েছেন বগুড়ার শিবগঞ্জের আনসার আলী। আর তার মাধ্যমে ঘুরিয়েছেন নিজের ভাগ্যের চাকা।
কঠোর পরিশ্রমের সঙ্গে সাধনায় মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানেই সাফল্য ধরা দেয় আনসার আলীর হাতে। স্বপ্নকে দিয়েছেন বাস্তব রূপ।
মাত্র তিন শতক জমিতে শুরু হলেও এখন তার প্রায় ৩০ বিঘা জমিতে ‘ওয়েস্টার্ন ভেজিটেবলস প্রোডাকশন কৃষি ফার্ম’। গ্রামীণ অর্থনীতিতে তার কৃষি ফার্মটি অনেকের আশার বাতি জ্বালাতে শুরু করেছে।
সরেজমিনে তার ফার্মটি ঘুরে পরিচয় ঘটে প্রায় ২৫ রকমের বিদেশি সবজির সঙ্গে। সেখানে এখন শোভা পাচ্ছে অ্যাসপারাগাস, সুইটকর্ন, ব্রকলি, এটকা বিজ, আইজ বাক লেটুস, লোকাল লেটুস, চেরি টমেটো, বিট রুট, থাই আদা, থাই পাতা, স্কোয়াশ, শিমলা মরিচ, বেবি কন, চাইনিজ ক্যাবিস, পেঁচ পাতা, স্যালারি, ফাসলি, লিক, থাইল্যান্ডের তেঁতুল, জাপানি পালং, অ্যাভোকাডো সবজি।
আনসার আলী শুরুতে মাত্র চার শতক জমিতে ওয়েস্টার্ন রমাভিট জাতের টমেটো চাষ করেন। হল্যান্ডের সবজি। দেখতে অনেকটা পেঁপের মতো। খেতে খুব সুস্বাদু। মাত্র ৮০ দিনে ৪০ মণ ফলন হয়। খরচ মাত্র দু-তিন হাজার টাকা। বিক্রি করেন ১৫-১৬ হাজার টাকা।
চাষের তালিকায় থাকা ক্যাপসিকাম জাতের মরিচ প্রথমে তিনি মাত্র তিন শতক জমিতে লাগান। বেশ ভালো ফলন হয়। কিন্তু মিষ্টি হওয়ায় এলাকার মানুষ ক্ষেতের সব মরিচ খেয়ে ফেলে। তাকে বেশ লোকসান গুনতে হয় তাকে। পরের দফায় সাত শতক জমিতে এই মরিচ লাগান। ঢাকা থেকে ২০০ গ্রাম বীজ ৪০০ টাকায় কিনে আনেন। জমি চাষে লাগে মাত্র ৫০ গ্রাম বীজ। ব্যয় হয় এক হাজার টাকা। বিক্রি করেন ১৮ হাজার টাকা।
আনসারির আলীর শুরুটা ১৯৯০ সালে। এরপর তাকে আর পিছু তাকাতে হয়নি। অবশ্য এর আগে তিনি সুপারি বিক্রি করতেন। বিভিন্ন দেশীয় সবজি চাষ করতেন। কিন্তু তাতে ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। ওই সবজি চাষি বলেন, ১৯৯০ সালে টমেটোর মধ্য দিয়ে তিনি বিদেশি সবজি চাষ শুরু করেন। ১৯৯১ সালে শুরু করেন মরিচের চাষ। সে সময় নিজস্ব সম্পত্তি বলতে তার দুই বিঘা চাষের জমি ছিল। ১৯৯৬ সালে চাষ তালিকায় যুক্ত করেন অ্যাসপারাগাস। এটি দেখতে সবুজ রঙের চিকন ডাঁটার মতো। ছোট পাতার আবরণে আবৃত সবজি। অ্যাসপারাগাস লিলি গোত্রের বহুবর্ষজীবী গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ। আমাদের দেশে এখনো পর্যপ্ত না থাকলেও উন্নত বিশ্বে এটি বহুল ব্যবহৃত বিলাসী সবজি হিসেবে পরিচিত ।
দেশে এই সবজির ব্যবহার নতুন হলেও ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকা ও পশ্চিম এশিয়ায় অ্যাসপারাগাস ব্যাপক আকারে চাষ হয়। ফলনও হয় ভালো। বাজারও বিশ্ববিস্তৃত। এই সবজি সাধারণত বিভিন্ন ধরনের স্যুপ তৈরিতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
এসব জাতের সবজি কেউ সহজে চাষ করে না। সিংহভাগ কৃষক এখনো ধান চাষের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু ধান চাষে খুব একটা লাভ হয় না। তবে বিদেশি জাতের সবজি চাষে কয়েক গুণ বেশি লাভ হয়। তাই বিদেশি সবজি চাষে ঝুঁকে পড়েন।
আনসার আলীর সঙ্গে কথা বলে আরো জানা যায়, সুইটকর্ন থাইল্যান্ডের একটি সবজি। ভুট্টা নামে সর্বাধিক পরিচিত এই সবজি মিষ্টি বলে কাঁচা বা সিদ্ধ করে খাওয়া যায়। অ্যাসপারাগাস স্যুপে ব্যবহার হয়। এর ডাঁটা ধুয়ে পরিষ্কার করে কাঁচা খাওয়া যায়। ব্রকলি আরেক জাতের সবজি। ভাজি ও ঝোল করে এটি খাওয়া যায়। থাই পাতা, ক্যাপসিকাম, চেরি টমেটো, থাইল্যান্ডের তেঁতুলসহ অন্য সবজি কীভাবে খাবার হিসেবে ব্যবহার করা হয় তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা তুলে ধরেন এই চাষি।
শূন্য থেকে পথচলা শুরু হলেও আনসার আলী এখন ১৫ বিঘা জমির মালিক। কুঁড়েঘর থেকে নির্মাণ করেছেন পাকা বাড়ি। আনসার আলীর পাশাপাশি বগুড়ার বিভিন্ন স্থানে কৃষকরা এখন বিদেশি জাতের সবজি চাষে মনোযোগী হচ্ছেন। গাবতলী উপজেলার আকন্দপাড়া কৃষক সমবায় সমিতির উদ্যোগে এবং আইএফআইসির তত্ত্বাবধানে মিন্টু জাতের বিদেশি টমেটো চাষ হচ্ছে। স্থানীয় কৃষক এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, সেখানকার টমেটো প্রতিদিন বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন শহরে সরবরাহ হচ্ছে। কৃষকরাও অধিক লাভবান হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন তারা। গ্রামের ওই সব কৃষকের বীজ সরবরাহ করে সহযোগিতা করছে লাল তীর কোম্পানি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বগুড়ার উপপরিচালক প্রতুল চন্দ্র সাহা জানান, ওয়েস্টার্ন সবজি দেশীয় জাতের সবজির চেয়ে বেশি লাভজনক হলেও বাংলাদেশে এখনো এর বাজার তৈরি হয়নি। কৃষকদের মধ্যে আস্তে আস্তে পরিচিতি লাভ করছে। শিবগঞ্জের আনসার আলীর পাশাপাশি এখন বগুড়ায় অনেক কৃষক আগ্রহ প্রকাশ করছেন ওই সব সবজি চাষে। তাদের যথাযথ পরামর্শ এবং চাষের কৌশল শিখিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
(ঢাকাটাইমস/২৭জানুয়ারি/মোআ)