ঢেলে না সাজালে বন্ধ হবে ঢাকাই চলচ্চিত্র: আজিজ
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পের একটি বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে এখন জাজ মাল্টিমিডিয়া। এর কর্ণধার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আব্দুল আজিজ। এই শিল্প ছাড়াও তার আরও বেশি কিছু ব্যবসা রয়েছে। তার হাত ধরেই মূলত বাংলাদেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি যেন কিছুটা আলোর দেখা পায়। দেশের সিনেমা হল ডিজিটালাইজড করা, ডিজিটাল সিনেমা নির্মাণ থেকে শুরু করে নায়ক-নায়িকা তৈরিতে তার অবদান উল্লেখযোগ্য। কিন্তু বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নিয়ে তারও রয়েছে হতাশা। তিনি বলছেন, নতুন করে ঢেলে না সাজালে শিগগিরই বন্ধ হবে যাবে ঢাকাই চলচ্চিত্র। বৃহস্পতিবার ঢাকাটাইমসের কথা হয় এই দূরদর্শী মানুষটির সঙ্গে। চলচ্চিত্রশিল্পের আজকের দুরবস্থা আর সংকট উত্তরণ নিয়ে নিজের পর্যবেক্ষণ ও ভাবনার কথা জানান তিনি।
এখন কী কী কাজ করছে জাজ মাল্টিমিডিয়া?
এখন বেশ কয়েকটি ছবির বিভিন্ন পর্যায়ের কাজ নিয়ে ব্যস্ত জাজা। ‘বস টু’ ছবির শুটিং আর ‘পোড়ামন ২’-এর প্রি-প্রোডাকশন চলছে। ‘নবাব’, ‘ধ্যাতত্যারিকি’ ও ‘পাষাণ’ চলচ্চিত্রের পোস্ট প্রোডাকশনের কাজ চলছে। এ ছাড়া ‘মেয়েটি এখন কোথায়’ যাবে মুক্তি পাবে শুক্রবার।
আপনাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
২০১৮ সালে বোম্বের ছবি বানাতে চলে যাবে জাজ মাল্টি মিডিয়া। এ নিয়ে একটি হিন্দি গল্প নির্বাচন করা হয়েছে। ছবিটি নিয়ে এখন পরবর্তী ধাপের কথাবার্তা চলছে। সব ঠিক হলে সবাইকে জানানো হবে। এছাড়া জাজ খুব শিগগিরই নতুন সিনেমার জন্য নতুন টিভি নিয়ে আসছে। কাগজপত্র সব তথ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়েছে।
নায়ক আলমগীরের নতুন সিনেমা ‘একটি সিনেমার গল্প’-এর সঙ্গেও জাজ মাল্টিমডিয়া রয়েছে বলে শুনেছিলাম।
হ্যাঁ, নায়ক আলমগীরের চলচ্চিত্র ‘একটি সিনেমার গল্প’-এর সহযোগী প্রযোজনা করছে জাজ মাল্টিমিডিয়া। ছবিটি অর্গানাইজ ও দেখভাল করছে জাজ। এমনকি ডিস্ট্রিবিউশনও করবে জাজ মাল্টিমিডিয়া।
এবার ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি। যৌথ প্রযোজনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময়ে জাজের বিরুদ্ধে নীয়মনীতি না মানার অভিযোগ রয়েছে, এটি কেন?
জাজ নিয়ম-নীতি মানে না, কারণ হচ্ছে যৌথ প্রযোজনায় দুই দেশের সবকিছু ফিফটি ফিফটি থাকার কথা থাকলেও জাজ আমাদের দেশের অভিনেতা-অভিনেত্রী কলকাতার চেয়ে বেশি নেয়। এ নিয়েই শুধু কথা আসতে পারে। এই জন্যই হয়তো মানুষ বলে জাজ যৌথ প্রযোজনার নিয়মনীতি মানে না।
জাজ আগে থেকে এখন কম প্রচারণায় আসছে বলে কি আপনি মনে করেন?
আগে সব সিনেমার বিলবোর্ড ও পোস্টার আমরা বেশি করতাম। এখন সরকারের বিধি-নিষেধের কারণে বিলবোর্ড করা হয় না। পোস্টারও কম করা হয়। এসব কারণে হয়তো মনে হতে পারে প্রচারণায় কম যাচ্ছে জাজ। তবে এখন অনলাইন বেশি শক্তিশালী হওয়ায় অনলাইনেই প্রচারণা বেশি করা হয়। পত্রিকা, টিভি ও অনলাইনেই তাই বেশি কাভার করা হয়। আমাদের শিকারি, বাদশা ও প্রেমি ও প্রেমি ভালো ব্যবসা করেছে।
জাজ ছাড়াও আপনার আরও অন্যান্য ব্যবসা রয়েছে বলে জানি, সে ক্ষেত্রে ব্যক্তি আব্দুল আজিজ কীভাবে সব কিছু সমন্বয় করেন?
সকাল আটটা থেকে ৫টা পর্যন্ত আমি অন্যান্য ব্যবসায় সময় দেই। আর সন্ধ্যায় জাজে সময় দেই। এভাবে সমন্বয় করি। আর আমার বার্ষিক যে টার্নওভার হয় তার তিন শতাংশ হচ্ছে জাজ মাল্টিমিডিয়া।
মিডিয়ায় আসার আগে আব্দুল আজিজ কেমন মানুষ ছিলেন, আর এখন কেমন? মিডিয়া আগের আজিজকে পরিবর্তন করে ফেলেছে কি না?
মিডিয়ায় আসার আগে আমি যেমন ছিলাম, এখনও আগের মতো আছি। তবে এখন মানুষ আমাকে চিনে। তারা আমাকে ফলো করে। প্যারিসেও মানুষ আমার সঙ্গে ছবি তুলতে চেয়েছে। এগুলো অবশ্যই ভালো লাগে। তবে আবার এই প্রচার কখনো ভালো লাগে, কখনো খারাপ লাগে। এটা সময় ও মুডের ওপর নির্ভর করে। তবে আমার পরিচিতির চাহিদা কখনো ছিল না। নইলে আমি নিজেই হিরো হতাম।(হেসে) এখন হিরো তৈরি করি।
আপনার অন্যান্য ব্যবসার অভিজ্ঞতা থেকে বলুন ওই ক্ষেত্রের মানুষের সঙ্গে মিডিয়ার মানুষের পার্থক্য কেমন?
এখন সিনেমার ব্যবসা খুব খারাপ। অনেক দিন ধরে এই ইন্ডাস্ট্রির অনেকের কাজকর্ম নাই। তাই এই সেক্টরে একটি শূন্যতা বিরাজ করছে। এসব কারণে এখানে কোনো মূলধন বা কোনো সম্ভাবনা দেখা দিলে তা দ্রূত শুষে নেয় এখানকার মানুষদের একটি বড় অংশ। যে প্রযোজক নতুন আসে, সেই শোষিত হয়। নতুন প্রডিউসারদের কমপক্ষে ৩০ শতাংশ টাকা এদিক-সেদিক নষ্ট হয়ে যায় এ ধরনের মানুষের কারণে। অন্য কোনো ব্যবসায় এমন দেখা যায় না। সেখানে এমন হাহাকার নেই। আমি যখন এই সেক্টরে আসি, তখন ‘ভালোবাসার রঙ’ সিনেমাতেও আমার অনেক ক্ষতি হয়। অনেক শোষিত হয়েছি আমি। তবে এরপর আর কেউ আমাকে শোষণ করতে পারেনি। এখানে সিনেমার হলে টিকেট সেলেও চুরি হয়। অথচ অন্য কোথাও কোনো ব্যবসায় সেলসে চুরি হয় না। অন্যান্য ব্যবসায় সেলে একটি কমিশন থাকে। এখানে কমিশন ও চুরি দুটোই হয়।
চলচ্চিত্র শিল্পের বর্তমান ব্যবসার অবস্থা কী? একটি সিনেমা থেকে কীভাবে আয় হয়?
এখানে প্রতিটি ক্ষে্ত্রে প্রতিবন্ধকতা বিরাজ করছে। ছবি রিলিজের ক্ষেত্রে ঢাকার একটি হলে প্রডিউসার পায় ২০ শতাংশ টাকা। দেশের অন্যান্য জায়গায় হলের ট্যাক্স, টিকিট ও প্রজেকশন খরচ শেষে একজন প্রডিউসার পায় ১ লাখ টাকায় ৩০/৩২ হাজার টাকা। এখানে অনেক প্রডিউসার এমনটা জেনে আসেন যে, এক কোটি টাকার সিনেমা বানালে পাঁচ কোটি টাকা আয় করবেন। তারা ভুলের সাগরে আছেন। একমাত্র ঈদে ছাড়া ও ‘আয়নাবাজি’ সিনেমা ছাড়া কেউ ব্যবসা করতে পারেনি। পোস্টার ও রিলিজ খরচও কেউ উঠাতে পারেনি। কারণ পোস্টার ও রিলিজ খরচে ১২ থেকে ২০ লাখ টাকা লাগে। শাকিবের ছবিই সর্বোচ্চ আয় করেছে ৩৮ লাখ টাকা, যেখানে ছবির খরচই এক কোটি টাকার উপরে।
কারা এর জন্য দায়ী বলে আপনি মনে করছেন?
মূলত হল মালিকরা আগে প্রডিউসার সমিতির নেতা হতেন সব সময়। এই কারণেই এ ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। এখানে সবাই নিজেদের স্বার্থটাই আগে দেখে। গত এক বছরে জাজ ছাড়া কোনো প্রডিউসার একবারের বেশি ছবি বানাতে পারেনি। কারণ সবাই লসে আছে। আমিও লসে আছি, তাই বোম্বের দিকে চলে যাচ্ছি। এখানে সিনেমার ব্যবসা বন্ধ করে দিব। অবশ্যই এই দেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিও বন্ধ হয়ে যাবে। এখন পুরো সিস্টেমটাই ক্ষতিকর হয়ে গেছে। পুরোটা আবার ঢেলে সাজাতে হবে। নইলে সম্ভব না। আসলে আবার নতুন করে সাজালেও সম্ভব না। কারণ সবাই নিজের স্বার্থ দেখে এখানে। একে আসলে আর কেউ বাঁচাতে পারবে না। এখানে অনলাইনে কিছু মানুষ ও গ্রুপ আছে যারা প্রতিটি ছবিকেই অনলাইনে হিট বানিয়ে দেয়। প্রতিটি নায়ক-নায়িকা তাদের হিসেবে হিট হয়। আর যেসব প্রযোজক নতুন আসছে, তারা ভাবছে যেহেতু এত ছবি ব্যবসা সফল হচ্ছে তাহলে আমাদের সিনেমাও ব্যবসা সফল হবে। এভাবেই তারা আসল খবরের আড়ালে থাকছে। ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে তারা এই ব্যবসায় আসছে। নইলে তারা আসল খবর জেনে-বুঝে নতুন কোনো পদ্ধতি প্রয়োগ করে বা তৈরি করে আসতে পারত।
তাহলে এই শিল্পের ভবিষ্যৎ কী?
এখানে এখন একমাত্র বোকারা আবেগের বশবর্তী হয়ে ছবি বানাবে। নইলে ভালোবেসে অথবা কারো মন রক্ষার্থে প্রডিউস করবে। কিন্তু ব্যবসায়িকভাবে কেউ ছবি বানাতে পারবে না। ভবিষ্যতে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি বন্ধ হয়ে যাবে। শুধু জাজ সরে গেলেই বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ব্যবসা ডুবে যাবে। এক-দেড় শতে নেমে আসবে হল সংখ্যা। এখন সারা বছর রানিং থাকে ২০০ হল। ঈদে তা হয় ৩০০ এর মতো।
কীভাবে চলচ্চিত্র শিল্প আবার মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে বলে আপনি মনে করছেন?
বাংলাদেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিকে সার্ভাইব করতে হলে অবশ্যই প্রথম ও একমাত্র শর্ত হলো গ্রস সেলের ৫০ শতাংশ একজন প্রডিউসারকে পেতে হবে। তবেই যদি আবার নতুন করে ঘুরে দাঁড়ায় এই ইন্ডাস্ট্রি। এ ক্ষেত্রে উত্তরণের জন্য অবশ্যই সরকারের হস্তক্ষেপ লাগবে। নইলে কোনো পথ নেই।
নতুন নায়ক-নায়িকা তেমন তৈরি হচ্ছে না কেন?
নতুন নায়ক-নায়িকা যেভাবে আসার কথা, সেভাবে আসছে না। শাকিব খানের পরিবর্তে যদি একজন নতুন কাউকে নেয়া হয় নামমাত্র টাকায়, তাহলে বাকি টাকাও সেই নায়ক বা নায়িকার গ্রুমিংয়ে ব্যয় করে নিয়ে আসতে হবে। তার প্রচার-প্রচারণায় খরচ করতে হবে। তবেই একজন নতুন নায়ক-নায়িকা দাঁড়াতে পারবে। কীভাবে কথা বলতে হবে, চলাফেরা করতে হবে তা অনেক নায়ক-নায়িকাই জানেন না। এগুলো শিখে আসতে হবে। স্টারিজম না শিখে এই সেক্টরে হুট করে চলে এলে হিতে বিপরীত হয়, হতাশায় ভুগে অনেকে।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
আপনাকে ও ঢাকাটাইমসকেও অনেক ধন্যবাদ।
(ঢাকাটাইমস/১০মার্চ/মোআ)
মন্তব্য করুন