সস্তা খাবারে কাটাতে হচ্ছে দিন

রুদ্র রাসেল, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ০৪ মার্চ ২০২৩, ০৯:৪৮

শুক্রবার সকাল সাড়ে ৯টা। পেছনের পকেটে থাকা বাজারের ভাঁজ করা খালি ব্যাগটি বের করে ধীর পায়ে রামপুরা বাজারের ভেতর হাঁটছেন বেসরকারি কুরিয়ার সার্ভিসের অফিস সহকারী পলাশ খাঁন। চোখ তার দোকানে সাজিয়ে রাখা মাছ-মাংস, তরিতরকারিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের পসরায়। কখনও কখনও অন্য ক্রেতাদের দরদাম করা নিরবে দেখছিলেন কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে। মাসিক ১৮০০০ টাকা বেতনে চাকরি করে স্ত্রী, মা ও স্কুল পড়ুয়া দুই সন্তান নিয়ে রামপুরা এলাকায় ভাড়া বাসায় বাস করা পলাশ খাঁন একপর্যায়ে দাম করছিলেন মুরগির চামড়া ও পায়ের। ব্রয়লার মুরগি ড্রেসিং (পশম ও চামড়া ছাড়ানো) শেষে ক্রেতাদের রেখে যাওয়া উচ্ছিষ্ট অংশ এগুলো, যা পরবর্তীতে দোকানিরা গরিব মানুষের কাছে বিক্রি করে থাকেন। এ সময় কথা হয় তার সঙ্গে।

পলাশ ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আগে শুক্রবার ছুটির দিনে বাসায় মাংস-পোলাও রান্না করা হতো। মাঝে মধ্যে দাওয়াত করা হতো আত্মীয়দের। কিন্তু দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় এক বছর ধরে বাসায় স্বজনদের দাওয়াত করাতো দূরের কথা নিজেরাই চলতে কষ্ট হচ্ছে। বাচ্চারা মুরগি খেতে চায়। কিন্তু এত টাকা নষ্ট করলে পুরো মাস সংসার চালানো অসম্ভব। তাই মুরগির চামড়া ও পা কিনতে দরদাম করছি।’

সংসার চালানোর এ করুণ বর্ণনা দিতে গিয়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে সবজির দোকানের দিকে হেঁটে গেলেন পলাশ মিয়া।

শুধু তিনিই নয়, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে স্বস্তা খাদ্যপণ্য কেনার কথা জানালেন নিম্ন ও মধ্যবিত্ত আরও কয়েকজন ক্রেতা। তারা বলছেন, ‘সামনে রমজান। আমরা নিরুপায়। কবে কমবে এই দাম। আয় তো বাড়ছে না। এ শহরে পরিবার নিয়ে টিকবো কিভাবে?’

ক্রেতারা জানান, সরকার নির্ধারিত মূল্যে তেল, চিনিসহ কোনো পণ্যই মিলছে না। একটি পণ্যের দাম ৫০ টাকা বাড়লে কমে ৫ টাকা, এরপর আবারও বাড়ে।

এদিকে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মাছ, মাংস ও সবজির দাম। মাংসের দাম বাড়ায় ব্রয়লার মুরগি শেষ ভরসা হিসেবে থাকলেও দফায় দফায় দাম বাড়ায় এটিও এখন স্বল্প আয়ের মানুষের পক্ষে কেনা দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া সপ্তাহ ব্যবধানে দামে ভোগাচ্ছে ডাল ও ছোলাও। ডিমের দামেও উত্তাপ। শীতের সবজির দাম বাড়তি। আর গ্রীষ্মের যে সবজি বাজারে এসেছে, তাতেও হাত দেয়ার অবস্থা নেই সাধারণ ক্রেতাদের।

গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজার, বাড্ডা, মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট, রামপুরা বাজারসহ বেশ কয়েকটি বাজার ঘুরে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামের এ চিত্রই দেখা গেছে।

দফায় দাফায় দাম বেড়ে এ সপ্তাহে ব্রয়লার মুরগির দাম ঠেকেছে ২৪০-২৫০ টাকায়, যা গত সপ্তাহে ছিল ২২০-২৩০ টাকা পর্যন্ত। এ ছাড়া দাম বেড়ে প্রতি কেজি গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৭৫০ টাকায় আর খাসির মাংস বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ১০০ টাকা দরে। মুরগির দামের মতো বাড়তি ডিমের দামও। এ সপ্তাহে ৫০ টাকা হালি বিক্রি হচ্ছে ডিম।

রামপুরা বাজারের গরুর মাংস বিক্রেতা জমির উদ্দিন বলেন, গত মাসেও ৭০০ টাকা কেজি গরুর মাংস বিক্রি করেছি। এখন ৫০ টাকা বেড়েছে। সপ্তাহখানেক আগেও ২০-৩০ টাকা কমে বিক্রি হয়েছিল কিন্তু দাম বাড়ায় এখন আর সেটি সম্ভব হচ্ছে না।

এ বিষয়ে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান গতকাল ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘সামনে রমজান। দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়াটাকে যেভাবেই হোক থামাতে হবে সরকারকেই। স্বল্প আয়ের মানুষকে বাঁচাতে জরুরি ভিত্তিতে উদ্যোগ নিতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিকে বৃদ্ধি করে হোক, আর যেভাবেই হোক- বেশিরভাগ মানুষের কষ্ট লাঘব করতে হবে।’

বাজারে মনিটরিং বাড়ানো এবং সিন্ডিকেট নির্মূলে ব্যবসস্থা গ্রহনেরও তাগিদ দেন এই বিশেষজ্ঞ।

এদিকে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত জরিপ করে বাংলাদেশের নিম্ন আয়ের মানুষের আয়-ব্যয় নিয়ে। এতে দেখা গেছে, ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুৎ বাবদ খরচ বাড়ায় সামগ্রিকভাবে জীবনযাপনের খরচ বেড়ে গেছে। এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি বিপদে আছেন ৫৩ শতাংশ মানুষ। খাবারের দাম বাড়ায় তারা তাদের জীবনযাত্রার অন্যান্য খরচ কমিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছে।

জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, ৫৩ শতাংশ মানুষ পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে গিয়ে জীবনযাপন ও খাদ্য বাবদ খরচ কমিয়েছে, তারা টিকে থাকতে তিনটি উপায় বেছে নিয়েছে। এর মধ্যে ২৮ শতাংশ পরিবার বাকিতে খাবার কিনছে। ৫৩ শতাংশ ঋণ করছে, ১৫ শতাংশ তাদের সঞ্চয় বা জমানো টাকা ভেঙে প্রতিদিনের খরচের জোগান দিচ্ছে। বাকি ৪ শতাংশ পরিবার জমি বিক্রি করছে বা অন্যত্র চলে গিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। সার্বিকভাবে মাত্র ১৩ শতাংশ পরিবার সরকারি-বেসরকারি সহায়তা পাচ্ছে। জরিপে দেখা গেছে, একজন মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম যতটা খাবার দরকার, তার দাম এক বছরে ১২ শতাংশ বেড়েছে। বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম খাবার কেনা বাবদ মাসে মাথাপিছু খরচ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ২৩৯ টাকা, যা উপার্জন করা সাধারণের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে। ২২ শতাংশ মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।

ডব্লিউএফপির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, খাদ্যপণ্যের উচ্চমূল্য ৬৮ শতাংশ মানুষের জন্য গভীর দুশ্চিন্তার বিষয়। খাদ্যপণ্যের মধ্যে চালের দাম এক বছরে বেড়েছে ১১ শতাংশ। আর কোভিড সংক্রমণের আগের সময় অর্থাৎ ২০২০ এর মার্চের আগের তুলনায় বেড়েছে ৬১ শতাংশ।

বাজারে আগুন

প্রকারভেদে সাধারণ চাষের মাছের দাম কেজিতে বেড়েছে প্রায় ৪০-৫০ টাকা পর্যন্ত। ইলিশ-চিংড়ির পাশাপাশি দেশি পদের (উন্মুক্ত জলাশয়ের) মাছগুলোর দাম বেড়েছে ১০০-৩০০ টাকা পর্যন্ত।

বাজার ঘুরে দেখা গেছে, চাষের পাঙাশ-তেলাপিয়া থেকে শুরু করে দেশি প্রজাতির সব ধরনের মাছের দাম বেড়েছে। আগে প্রতি কেজি পাঙাশ বিক্রি হতো ১৫০-১৬০ টাকা, যা এখন ১৮০-২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে তেলাপিয়া মাছের কেজি হয়েছে ২২০-২৫০ টাকা, যা আগে ১৮০-২০০ টাকায় কেনা যেত।

এছাড়া প্রতি কেজি ছোলা বিক্রি হচ্ছে ১০০-১০৫ টাকা দরে, যা গত সপ্তাহে ৯০-৯৫ টাকা ছিল। প্রতি কেজি ১০ টাকা বেড়ে বুটের ডাল ৯৫-১০০ এবং মাসকলাইয়ের ডাল ১৫৫-১৬০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। শীতের সবজির দাম ১০-২০ টাকা বেড়েছে। প্রতি কেজি বেগুন ৮০ টাকা, করলা ১২০ টাকা, বরবটি ১২০ টাকা, পটোল ১২০ টাকা, ঝিঙা ৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। পেঁয়াজের দাম কম থাকলেও কমেনি আদা-রসুনের দাম। প্রতি কেজি আদা মানভেদে বিক্রি হচ্ছে ১৪০-২৮০ টাকা ও রসুন ১৬০-২২০ টাকা দরে।

এ বিষয়ে ক্যাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে সীমিত আয়ের মানুষ ব্যয় সামলাতে খাবারের মেন্যু কাটছাঁট করছেন। পুষ্টিকর খাবার খেতে পারছেন না তারা। ফলে অপুষ্টিতে ভুগছেন, আক্রান্ত হচ্ছেন নানা রোগে। তাই চোখ ধাঁধানো বড় বড় প্রকল্পের দিকে নজর না দিয়ে সরকারের উচিত দেশের নিম্ন ও মধ্যবিত্তসহ সাধারণ মানুষের জীবন জীবিকা নির্বাহের দিকে মনোযোগ দেওয়া।’

টিসিবি ও খাদ্য বিভাগের মাধ্যমে সাশ্রয়ী মূল্যে খাদ্য-পণ্য বিক্রিসহ মধ্যবিত্তদেরও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনার পরামর্শ দেন নাজের হোসাইন।

(ঢাকাটাইমস/০৪মার্চ/আরআর/আরকেএইচ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :