এবার চালের বাজারে অস্থিরতা

রুদ্র রাসেল, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ০৯ আগস্ট ২০২২, ০৭:৪৭

জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির দুদিনের মাথায় অস্থির হয়ে উঠেছে দেশের চালের বাজার। মিলগেট থেকে শুরু করে খুচরা বাজার পর্যন্ত প্রতি কেজি চালের দাম বেড়েছে ৪ টাকা পর্যন্ত। প্রতি ৫০ কেজির বস্তায় পাইকারি পর্যায়ে দাম বেড়েছে অন্তত ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। খুচরা বাজারে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ। কারণ হিসেবে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে পরিবহন খরচ বৃদ্ধি পাওয়া ও সিন্ডিকেটকেই দুষছেন সংশ্লিষ্টরা। একইসঙ্গে, চালের পর্যাপ্ত মজুদ থাকলেও কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বাজারে দাম বাড়ানোর অভিযোগ রয়েছে অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে। ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) থেকে পাওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত এক বছরে চালের দাম ৭.০৩ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এছাড়া চালের সংকট যাতে সৃষ্টি না হয় সে জন্য সরকার চাল আমদানির অনুমতি দিলেও তেমন সাড়া দেননি ব্যবসায়ীরা।

এদিকে হঠাৎ চালের বাজারে কারা কেনো দাম বাড়াচ্ছে তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছেন কৃষি, খাদ্য ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীরা। আর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘জ্বালানি তেল, গণপরিবহনের ভাড়া বৃদ্ধির ফলে মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যত্তি ও নিম্নবিত্তের এখন ত্রাহি দশা। এ অবস্থায় চালের দাম বাড়লে মানুষের খাদ্যঝুঁকি আরো বাড়বে। দুর্দশার শেষ থাকবে না। এখনই চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।’

অন্যদিকে চালের বাজার হঠাৎ অস্থির হওয়ার পেছনে পুরনো সিন্ডিকেটকেই দায়ী করছেন ব্যবসায়ীরা। এই সিন্ডিকেট আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে জানিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার দাবিও তুলেছেন তারা। সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া একটি গোয়েন্দা সংস্থার গোপন প্রতিবদেনেও চালের বাজারে শক্তিশালী সিন্ডিকেটের কথা উল্লেখ করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। গতকাল রাজধানীর খুচরা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সরু চাল (মিনিকেট, নাজিরশাইল) ৭৬-৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মাঝারি চাল (পাইজাম ও লতা) বিক্রি হচ্ছে ৫৭ টাকা থেকে ৬৩ টাকা আর মোটা চাল (স্বর্ণা, চায়না ও ইরি) চাল বিক্রি হচ্ছিলো ৫১ থেকে ৫৫ টাকা।

ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসেবে এক সপ্তাহ আগে গত ১ আগস্ট প্রতি কেজি সরু চাল ৬২ থেকে ৭৫ টাকা, মাঝারি চাল ৫২ থেকে ৫৬ টাকা এবং মোটা চাল বিক্রি হচ্ছিলো ৪৮-৫০ টাকা দরে।

অন্যদিকে দেশের অন্যতম পাইকারি চালের বাজার চট্টগ্রামের পাহাড়তলিতে চিনিগুড়া চাল বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) রেকর্ড ৫ হাজার ৯শ টাকায় বিক্রি হচ্ছিলো। যা দুদনি আগেও ৫ হাজার টাকায় বিক্রি করা হচ্ছিলো। এই চালের বস্তা গতকাল খুচরা ব্যবসায়ীরা বিক্রি করছিলেন ৬ হাজার ৫শ টাকা পর্যন্ত। ওই পাইকারি বাজারে মোটা চালের বস্তা বিক্রি হচ্ছিলো ২১ টাকায়। যা দুতিন দিন আগেও ১৮শ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা হচ্ছিলো। কাটারিভোগ চালে বস্তা প্রতিক বেড়েছে ৩শ টাকা। দিনাজপুর, নওগাঁ ও বরিশালেও একই অবস্থা বলে খবর পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলছেন, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির পর উত্তরবঙ্গ থেকে চট্টগ্রামে বা ঢাকার কারওয়ানবাজারে চাল পরিবহনের খরচ ট্রাক-কাভার্ডভ্যান প্রতি ৬-৭ হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেছে। নওগাঁ থেকে ১৩ টন চাল নিয়ে কাভার্ডভ্যানের আসা ব্যবসায়ী আব্দুস সালাম জানান, তিন দিন আগে চাল নিয়ে নওগাঁ থেকে আসার পরিবহন খরচ পড়তো ১৫ হাজার টাকা আর সেই ভাড়া এখন ২০-২২ হাজার টাকা গুনতে হচ্ছে।

এ বিষয়ে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, ‘দেশে কোনো ধরণের খাদ্য সংকট নেই। চাল যথেষ্ট পরিমান মজুদ রয়েছে। অসৎ উদ্দেশ্যে কেউ দাম বাড়ালে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রী টিপু মুনশি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘চালের দাম বৃদ্ধির খবর আমার জানা ছিলো না। এখন শুনলাম। কারও কাছ থেকে দাম বেশি রাখলে সে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে অভিযোগ করলে বিক্রেতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ মন্ত্রী বলেন, ‘খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে চালের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে পর্যবেক্ষণ দিলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ব্যবস্থা নেবে।’

হঠাৎ কেনো চালের বাজার অস্থির এমন প্রশ্ন ছিলো কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকের কাছে। তিনি বলেন, ‘চালের কোনো ঘাটতি নেই। আর সরকারও চালের দাম বাড়ায়নি।’ তিনি বলেন, ‘যারা চালের বাজার অস্থিতিশীল করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

এদিকে ভোক্তাদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’র সভাপতি ও দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘জ্বালানি তেলের মূল্য যে হারে বাড়ানো হয়েছে তাতে অক্টোবর পর্যন্ত সব ধরণের পণ্যের দাম অত্যাধিক বেড়ে যাবে। জ্বালানি তেলের দাম বৃৃদ্ধির অস্বাভাকি রিঅ্যাকশন রয়েছে- যার প্রভাব ভোক্তার ওপর পড়ছে।’ তিনি বলেন, ‘সরকারতো জেনেশুনেই বিষ পান করেছে।’

গোলাম রহমান বলেন, ‘বাজারেতো সিন্ডিকেট রয়েছেই। তারপরও আমি বলবো সরকারই চালের দাম বাড়িয়েছে। সাধারণ ভোক্তার ভালোমন্দ দেখার কেউ আছে বলে আমার মনে হয় না।’ তিনি বলেন, সরকার জনসাধারণের ওপর কোনো সুবিবেচনা করছে না। জনগনের জন্য প্রকৃত ভালো সিদ্ধান্ত নিচ্ছে না।’ চালের বাজার অস্থিরতার বিষয়টি তাদের অধীন সংগঠন কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেতশের নজরে পড়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সরকারের কতগুলো ভুল সিদ্ধান্তে সাধারণ মানুষের অবস্থা সংকটাপন্ন। চালের বাজারের এই অস্থিরতা সংকটাপন্ন মানুষগুলোকে আরো সংকটাপন্ন করবে।’ জ্বালানি তেলের যে মূল্যবৃদ্ধি করা হয়েছে তা প্রত্যাহারের দাবি জানান তিনি।

চালের বাজারে সিন্ডিকেট, বলছে গোপন প্রতিবেদন

সম্প্রতি সরকারের একটি সংস্থা চালের বাজারের অস্থিরতা বিষয়ক একটি প্রতিবেদনে জমা দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারের মজুদে নতুন রেকর্ড তৈরি হলেও বাজারে চালের দাম কমছে না, বরং বাড়ছে। চালের বাজার অস্থিরতার পেছনে একই ব্যক্তিদের নাম আসছে বারবার। তারা সিন্ডিকেট করে চালের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। সারাদেশেই আছে তাদের সদস্য। এমনকি সিন্ডিকেটের সদস্যরা পাইকারি ও খুচরা বাজারের ব্যবসায়ীও। আর তাদের পেছনে কাজ করছে শক্তিশালী চক্র। এর আগেও একই ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দিয়ে ব্যবস্থা নিতে বলা হলেও নেয়া হয়নি কোন ধরনের ব্যবস্থা। এমন পরিস্থিতিতে সঠিক তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে গঠিত উচ্চ পর্যায়ের বিভিন্ন কমিটির কার্যক্রম ও মনিটরিং গতিশীল করার সুপারিশ করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে ধানের দাম বৃদ্ধি করা হয়। পরে ধানের মূল্য বৃদ্ধির অজুহাতে তারাই চালের দাম বাড়িয়ে দেয়। কেবল ব্যাপক চাহিদা থাকা মিনিকেট ( চিকন চাল) চালের ক্ষেত্রে তারা এ কৌশল অবলম্বন করেছে। এ সুযোগে পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা সব ধরনের চালের দাম বাড়িয়ে দিয়ে বাজার অস্থিতিশীল করেছেন। কিন্ত চালের দাম বাড়িয়ে কত টাকা সিন্ডিকেট হাতিয়ে নিয়েছে সে বিষয়ে প্রতিবেদনে উল্লেখ নেই।

অস্থিরতার পেছনে যেসব কারণ

খাদ্য অধিদপ্তর, ধান-চাল ব্যবসায়ী, ও বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, চালের মূল্য বৃদ্ধির পেছনে বেশকিছু কারণ রয়েছে। এর মধ্যে- এ্যানিমেল ফিড তৈরি ও রোহিঙ্গাদের খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে চালের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে বাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চালের বহুবিধ ব্যবহার বাড়ছে। এ্যানিমেল ফিড হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে চাল। মানুষের পাশাপাশি গবাদিপশুর খাবার হিসেবে চালের ব্যবহার দিন দিন বেড়েই চলছে। দেশে গড়ে ওঠেছে অসংখ্য গরু-ছাগল ও হাঁস মুরগির খামার। গত এক বছরে আটা ও গমের দাম বেড়ে যাওয়ায় এসব খামারে এখন চাল ব্যবহার করা হচ্ছে। এ্যানিমেল ফুড হিসেবেও কয়েক লাখ টন চালের চাহিদা তৈরি হয়েছে বলে সম্প্রতি জানিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। মিয়ানমার থেকে আগত ১০-১৫ লাখ রোহিঙ্গার খাদ্য হিসেবেও চাল দেয়া হয়। বছরে কয়েক লাখ টন চাল খাচ্ছে তারা। এতে করে বাড়তি চাপ তৈরি হচ্ছে। সরকার আগে কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান কিনলেও এখন মিলারদের কাছ থেকে চাল সংগ্রহ করে থাকে। এতে করে মিল মালিকরা সরকারকে চাল দিলেও খোলা বাজারে সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। এর নেতিবাচক প্রভাবে বাজারে চালের দাম বেড়ে যাচ্ছে। ভোগ্যপণ্যের বড় বড় কোম্পানি যেমন স্কয়ার, প্রাণ, আকিজ, এসিআই, সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ ও অন্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠান মজুদ বাড়িয়ে প্যাকেট করে চাল বাজারজাতকরণ করছে। ছোট ছোট মিলাররা এখন বড় প্রতিষ্ঠানের কাছে অনেকটাই জিম্মি। বড়রাই নিয়ন্ত্রণ করছে ছোটদের।

জানা গেছে, দেশে উৎপাদিত চালের একটি বড় অংশ আবার বিদেশে রফতানি করা হয়। বিশেষ করে দেড় থেকে ২ কোটি প্রবাসী বিদেশে অবস্থান করছেন। তারা বাংলাদেশী চালসহ বিভিন্ন পণ্য ব্যবহার করেন। এ কারণে বিদেশেও দেশী চালের চাহিদা রয়েছে। প্রবাসীদের কথা বিবেচনায় নিয়ে সুগন্ধি চালের পাশাপাশি সিদ্ধ চালও রফতানি করা হয়। এ কারণে দেশের চাহিদা মেটাতে সরকারী- বেসরকারী পর্যায়ে আবার চাল আমদানি করা হয়। থাইল্যান্ড, ভারত ও ভিয়েতনামসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে চাল আসে বাংলাদেশে। বাড়তি চাহিদা পূরণে গত বছরের এপ্রিল পর্যন্ত বেসরকারী পর্যায়ে ১০ লাখ টন চাল আমদানির অনুমতি দিয়েছিল সরকার। কিন্তু শুল্কমুক্ত সুবিধার বিষয়টি নিয়ে ব্যবসায়ীরা সন্তুষ্ট না হওয়ায় সেই সময় চাহিদা অনুসারে চাল আনা হয়নি। তবে সরকারী পর্যায়ে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী আমদানি করা হয়েছে। খুচরা পর্যায়ে বাজার নজরদারির অভাবেও দাম বাড়ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। কঠোর মনিটরিং না থাকার সুযোগ নিচ্ছেন অসাধু সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা। এ অবস্থায় দাম কমাতে চাল আমদানির সুযোগ আবার উন্মুক্ত করে দেয়ার কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা। আমদানি উন্মুক্ত করা হলে ব্যবসায়ীদের মজুদকৃত চাল বাজারে আসবে বলে মনে করা হচ্ছে।

চালের মজুদ

বর্তমানে মজুদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২০ লাখ ৭ হাজার ৪৪৫ মেট্রিক টন। এই প্রথম সরকারী মজুদ ২০ লাখের বেশি। এর আগে রেকর্ড মজুদ ছিল ২০১৯ সালের অক্টোবরে ১৯ লাখ ৭৫ হাজার ৬৩৮ মেট্রিক টন। বর্তমান মজুদ খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ে সরকারকে সুদৃঢ় অবস্থানে নিয়ে এসেছে। স্বস্তিদায়ক মজুদ গড়ে উঠলেও বাজারে চালের দাম বেড়েই চলেছে। অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে বাজারে চালের দাম বেড়েই চলেছে। সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশে মোট খাদ্য মজুদের ধারণ ক্ষমতা রয়েছে ২১ লাখ মেট্রিক টন। এছাড়া আরও কিছু গুদাম নির্মাণ করা হচ্ছে। এগুলোর নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হলে ধারণ ক্ষমতা আরও এক লাখ মেট্রিক টন বাড়বে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) মতে, যে কোন রাষ্ট্রের নাগরিকদের খাদ্য নিরাপত্তায় সরকারীভাবে কমপক্ষে ৬০ দিনের খাদ্য মজুদ রাখা প্রয়োজন। আমাদের মোট জনগোষ্ঠীর এক দিনের খাদ্য চাহিদা প্রায় ৪৬ হাজার টন। সে হিসাবে ৬০ দিনের জন্য খাদ্য মজুদ রাখার কথা ২৭ লাখ টন। সেখানে সরকারের কাছে খাদ্য মজুদ রয়েছে ২০ লাখ ৭ হাজার টন। পাশাপাশি বাংলাদেশের মানুষের ঘরে, মিল, বেসরকারী ব্যবস্থাপনায় খাদ্যপণ্য যথেষ্ট মজুদ রয়েছে বলে মনে করে সরকার। পৃথিবীর অনেক দেশেই এমন ব্যবস্থা নেই। চালের দাম বাড়ার কথা স্বীকার করে দিনাজপুর চেম্বারের সভাপতি ও মিল মালিক রেজা হুমাউন ফারুক শামীম চৌধুরী বলেন, ‘যদিও চাল আমাদানি হচ্ছে, কিন্তু ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় চাল বেশি দামে আমাদানি করতে হচ্ছে। ভারতসহ বিশ্ব বাজারে চালের দাম বেড়েছে। আমাদের দেশে চালের বাজার এখনো সহনীয় পর্যায়ে আছে।’

চাল আমদানির অনুমতি থাকলেও ডলার সংকট ও দাম বেশির কারণে আমদানিতে গতি নেই দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দরে। আমাদানিকারক শাহিন হোসেন জানান, ‘বাড়তি দামে বড় চালানে চাল আমদানিতে ব্যবসায়ীরা আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।’

নওগাঁর মফিজ উদ্দিন অটোমেটিক রাইসমিলের স্বত্বাধিকারী মো. তৌফিকুল ইসলাম বাবু জানান, নওগাঁসহ দেশের বিভিন্ন জেলার চাল ব্যবসায়ীরা ভারত থেকে চাল আনার জন্য ইতোমধ্যে এলসি করেছে। কিন্তু গত ৭ থেকে ১০ দিনের ব্যবধানে ডলারের মূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি তাতে এলসির চাল দেশে আসার পর ব্যাংকে পেমেন্টে করার সময় অতিরিক্ত পেমেন্ট গুণতে হবে। আর এর প্রভাবটা চালের ওপর পড়বে। এতে চালের দাম বৃদ্ধি পাবে। যদি ডলারের বাজার স্থিতিশীল না হয়, তাহলে যে সকল ব্যবসায়ীরা প্রথমবার চাল নিয়ে এসেছে, পরবর্তীতে তাদের আর চাল আমদানি না করার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

নওগাঁর চাল আমদানিকারক এসএস অটোমেটিক রাইসমিলের স্বত্বাধিকারী মো. মোতাহার হোসেন পলাশ বলেন, মূলত বর্তমানে ভারতে চালের দাম বেশি হওয়ায় এলসির অনুমতি পাওয়ার পরেও আমাদের হিসাব করতে হচ্ছে, বর্তমান বাজারে ভারতে যে চালের দাম সে দামে চাল নিয়ে আসা যাবে কি না। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, বর্তমানে আমাদের দেশে ডলারের যে ঊর্ধ্বগতি তাতে ভারত থেকে চাল এসে কত ডলারে পেমেন্ট করতে হবে, তা নিয়ে দ্বিধা দ্বন্দ্বে আছি। এলসির চাল আনার পর বেচার পরে যদি দেখা যায়, ডলারের দাম অনেকখানি বেড়ে গেছে; তাহলে আমাদের পক্ষে ওই লোকসানটা পূরণ করা সম্ভব নয়। এটাকে আমরা বিশাল একটা রিস্ক মনে করছি।

নওগাঁ জেলা ধান চাল আড়তদার ও ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি নিরোদবরণ সাহা চন্দন বলেন, আমদানি খুলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমদানির ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে ডলারের দাম নিয়ে। ডলার প্রতি ৯৪ টাকায় যে এলসিগুলো হচ্ছে, এ গুলোর বিল যখন আসতেছে তখন পেমেন্টের সময় সেটা ১০০ থেকে ১০২ ডলার পেমেন্টে করতে হচ্ছে। ফলে ৯৪ টাকার ডলারে চাল নিয়ে এসে আমরা ১০২ ডলারে যখন বিল পেমেন্ট করবো তখন প্রকৃতপক্ষে ব্যবসায়ীদের লোকসান গুণতে হবে।

রাজধানীর কাওরান বাজারের আল্লাহর দান রাইস এজেন্সির মালিক ও পাইকারি চাল ব্যবসায়ী মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, মিলারদের কারসাজিতে পুরো বছর ধরে চালের দাম বাড়তি। নানা অজুহাতে তারা দাম বাড়িয়েছে।

কখনো সরবরাহ সংকট, আবার কখনো ধানের দাম বেশি বলে চালের দাম বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কথা বলে বস্তায় সর্বোচ্চ ৪০০ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়ে দেওয়া হলো। ফলে বেশি দামে কিনে পাইকারি পর্যায়ে বেশি টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আসাদুজ্জামান ঢাকা টাইমসকে বলেন, সাধারণত বোরো মৌসুম শুরু হলে চালের দাম অনেকটাই কমে যায়। স্বস্তি পায় মানুষ। এবার দেখা যাচ্ছে বিপরীত চিত্র। নতুন মৌসুমের চাল বাজারে এসে যখন দাম কমার কথা, তখনই দাম বাড়ছে। এখন আমাদের কষ্টের শেষ নেই। যে বেতন পাই তাতে আর সংসার চালাােনর উপায় নেই। স্ত্রী সন্তানসহ এ শহর ছেড়ে চলেই যেতে হবে।’

প্রসঙ্গত, এই বোরো মৌসুমে দাম কমে যাওয়ার কারণ, বোরোতে দেশের মোট চালের প্রায় ৫৫ শতাংশ উৎপাদিত হয়। বিপুল সরবরাহ দাম কমিয়ে দেয়।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবার বোরো মৌসুমের শুরুতে হাওরে আগাম পানি এসে কিছু ধান নষ্ট হয়েছে। এ ছাড়া ঘূর্ণিঝড় অশনির কারণে সারা দেশে ব্যাপক বৃষ্টিপাত পাকা ধানের ক্ষতি করেছে। ওদিকে রাশিয়া, ইউক্রেন ও ভারত থেকে বিশ্ববাজারে সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গমের দাম বাড়ছে। যার প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের বাজারেও। বিশ্ববাজারে চালের দামও কিছুটা বাড়তি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এই যে এখন ধান ও চাল কিনে রেখে ভবিষ্যতে ভালো মুনাফা করার সুযোগ খুঁজছেন ব্যবসায়ীরা। উচ্চ হারে শুল্ক আরোপের কারণে বিদেশ থেকে চাল আমদানির সুযোগ কম, প্রতিযোগিতা কম। এমন পরিস্থিতিতে অনেক ব্যবসায়ী, চালকলের মালিক ও বড় কৃষক ধান কিনে রাখতে বিনিয়োগ করছেন; যা সরবরাহে টান তৈরি করে বাজারে দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) বৈশ্বিক দানাদার খাদ্যশস্য

উৎপাদনবিষয়ক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে আগের বছরের তুলনায় এ বছর দেড় লাখ টন চাল বেশি উৎপাদিত হবে। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরে ৩ কোটি ৬০ লাখ টন চাল হওয়ার কথা।

(ঢাকাটাইমস/০৯আগস্ট/আরআর/এফএ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :