বিএনপি কি আবার জ্বালাও পোড়াও আন্দোলনের দিকে যাচ্ছে?

মো. সাখাওয়াত হোসেন
 | প্রকাশিত : ০৫ মার্চ ২০২৩, ১৪:২৩

সম্প্রতি সিরাজগঞ্জে আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশে হামলার অভিযোগ উঠেছে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। এসময় ১২টি মোটরসাইকেল ভাংচুর করে আগুন দেওয়া হয়েছে বলেও দাবি করা হয়।

এদিকে গাজীপুরের শ্রীপুরের বরমী বাজারে বিএনপির পদযাত্রা থেকে আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের সামনে রাখা চেয়ার ভাংচুরের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসময় পিস্তল হাতে এক যুবকের ছবি ভাইরাল হয়।

সারাদেশের সব খবরাখবর পত্রিকার পাতায় উঠে আসে না, কেননা প্রমাণ ব্যতিরেকে সংবাদমাধ্যম খবর প্রকাশ করে না গণমাধ্যমে। আবার সাংবাদিক জানার পূর্বেই ঘটনাস্থল থেকে আলামত সরিয়ে ফেলা হয় কিংবা ভয়ে রাজনৈতিক বিষয়ে কেউ কেউ সাংবাদিকদের সামনে মুখ খুলতে নারাজ।

এ ধরনের ঘটনা দেশব্যাপী আরও ঘটতে পারে, কিন্তু এহেন অযাথিত ঘটনা পরিশীলিত রাজনীতির জন্য প্রতিবন্ধকস্বরূপ। রাজনৈতিক দলগুলোর জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী আচরণ প্রদর্শন করা উচিত, জনগণের ক্ষতি হয়, জনগণ ভোগান্তিতে পড়ে, রাষ্ট্রের সম্পদের অপচয় হয়, অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ে, শিক্ষার্থীরা বিপাকে পড়ে, বহির্বিশ্বে নেতিবাচক ইমেজ সৃষ্টি হয় এমন ধরনের অপরিপক্ক ও অগ্রহণযোগ্য কর্মসূচি প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের পরিহার করা উচিত। রাজনীতি হয়ে থাকে মানুষের কল্যাণের জন্য, মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে, অধিকার আদায়ের তাগিদে রাজনীতিবিদদের গৃহীত কর্মসূচি আপামর জনসাধারণের নিকট সর্বজনগ্রাহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়, বিপরীত পক্ষে জনগণকে বেকায়দায় ফেলার প্রয়াসে গৃহীত পদক্ষেপগুলো ঘৃণার বেসাতিতে জায়গা পায়।

বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ শান্তিপ্রিয়, শান্তিপ্রিয় মানুষ কখনোই বিশৃঙ্খল পরিবেশ পছন্দ করে না কিংবা অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টিকারীদের সমর্থন প্রদান করে না। বাংলাদেশের ইতিহাসে দেখা গেছে রাজনীতিতে মতবিরোধ থাকতে পারে, মতভেদ হতে পারে এবং এ সংক্রান্তে বিভিন্ন কর্মসূচি বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ হতে এসেছে এবং সাধারণ জনগণ তা পর্যবেক্ষণ করেছে। কিন্তু যে বা যারাই জনগণের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় তাদেরকে বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ কোনভাবেই সমর্থন প্রদান করেনি।বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন অজস্র উদাহরণ রয়েছে, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে খুব বেশি রাজনীতিবিদ এ ধরনের ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে নি, সে কারণেই তারা একের পর এক ভুল করে জনগণের নিকট হতে কালক্রমে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

অতীতেও আমরা দেখেছি ২০১৪ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিএনপি জামায়াতের দেশব্যাপী হরতাল অবরোধের ধারাবাহিকতায় আগুন সন্ত্রাসের অবর্ণনীয় কার্যক্রম। এর ফলশ্রুতিতে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল দেশের আপামর জনসাধারণ। শিশু ও নারীরাও তাদের এ ভয়াবহ কর্মকান্ড থেকে রক্ষা পায়নি। মানুষের মনে আতঙ্ক ও ভয়ের সৃষ্টি হয়েছিল, একটি অস্থিতিশীল ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল জনগণ। জনগণ কখনোই ঐ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি চাইবে না। ২০১৪ সালে বাংলাদেশে যে অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, অসংখ্য মানুষ জ্বালাও পোড়াও রাজনীতির শিকার হয়ে নিহত হয়েছে, ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে হাজার হাজার মানুষ, বিনষ্ট হয়েছে অজস্র সম্পদ। এর দায় বিএনপি স্বীকার না করলেও তাদের উপরেই বর্তায়, কেননা নির্বাচনকে বাঁধাগ্রস্থ করতেই বিএনপি কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল এবং এসব ঘটনার কারণে আওয়ামী লীগ সহ অন্যান্য দল রাজনীতিতে নানাভাবে বিএনপিকে দোষারোপের সুযোগ পায়। কিন্তু রাজনীতিতে যেখানে বিএনপিকে প্রতিনিয়ত বিচক্ষণ ও কৌশলী হয়ে উঠার কথা সেখানে বিএনপি নিজেরাই নিজেদের উপর অভিযোগ দাখিলের সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে। এ ধরনের অনাকাঙ্খিত ইস্যু রাজনীতিতে বিএনপিকে জনগণ থেকে পালাক্রমে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে।

প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে মানববন্ধব ও শান্তি সমাবেশ খুবই শালীন নিদর্শন। সেখানে রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশকে লক্ষ্য করে হামলা চালানোর যে অভিযোগ বিএনপির বিরুদ্ধে এসেছে সেটি কোনভাবেই বিএনপির রাজনীতির জন্য সুখকর নয়। বিএনপির নেতৃবৃন্দের নানাবিধ বিষয়ে কাজ করার সুযোগ রয়েছে, অবশ্য পালনীয় কাজকর্ম রেখে অন্য দলের শান্তি সমাবেশে হামলা করা কোনভাবেই দলের জন্য মঙ্গলজনক হবে না। আওয়ামী লীগ সরকার দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায়, সরকার তথা দলটির বিরুদ্ধে বিএনপি কোন কার্যকর আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম হয়নি, এর পিছনের কারণগুলো বিএনপির খুঁজে বের করা উচিত। কারণগুলোকে খুঁজে বিএনপির সেসব সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত, কিন্তু বিএনপি সে পথে না হেঁটে উল্টো পথে হাঁটছে। শান্তি সমাবেশে আক্রমণের কোন মানে হতে পারে না, এটি পুরোপুরি আক্রোশের বহিঃপ্রকাশ। রাজনীতিতে মতবিরোধ হবে, মতভেদ থাকবে কিন্তু সেটি যখন ক্রোধে রূপান্তরিত হয় তখন বিষয়টি শৃঙ্খলাপূর্ণ রাজনীতির মধ্যে থাকে না। বিএনপি যদি মনে করে আবারও অবরোধ হরতাল দিয়ে জনগণকে বিপদের মধ্যে ধাবিত করে সরকারকে হটিয়ে ফেলবে, তাহলে সে ক্ষেত্রে তাদের কাজের কাজ কিছুই হবে না। বিএনপির উচিত হবে শান্তিপূর্ণ ও যৌক্তিক কর্মসূচি গ্রহণ করে জনগণের নিকট তাদের উত্থাপিত দাবিকে গ্রহণযোগ্য আকারে তুলে ধরা।

বিএনপি বিভিন্ন সময়ে বহুবার গণমাধ্যমে সরকার পতনের আন্দোলনের ঘোষনা দিয়েছে, বাস্তবে সেসব কার্যকর হয়নি। বিএনপির এ ধরনের সিদ্ধান্ত বাস্তবে রূপান্তরিত না হওয়ায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে বিএনপিকে নিয়ে সমালোচনা হয়েছে, অনেকেই ট্রল করছে, এটি একটি রাজনৈতিক দলের জন্য কোনভাবেই সুখকর নয়। আসলে এ ব্যাপারটিতে বিএনপি সাধারণ মানুষদের কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছে। যে সিদ্ধান্ত বাস্তবে রূপান্তরিত হবে না সে বিষয়ে জনমনে ঘোষণা দেওয়ার প্রয়োজন নেই, এতে দলের জনসমর্থন কমে আসে। বিএনপি যেহেতু অনুধাবনে সক্ষম হয়েছে তাদের আহবানে দলীয় নেতাকর্মীরা সাড়া দিচ্ছে না, সেহেতু তাদের কর্মসূচি ঘোষণার পূর্বে কর্মসূচি বাস্তবায়নের সম্ভাবতা যাচাই বাছাই করেই ঘোষনা প্রদান করা উচিত। যে ঘোষণা প্রদান কোনভাবেই বাস্তবায়নযোগ্য নয় সেসব জনসন্মুখে প্রকাশ করে দলকে হাসির পর্যায়ে নিয়ে আসার কোন মানে হয় না। কিন্তু এ ধরনের অসংখ্য উদাহরণ বিএনপির রাজনীতিতে পাওয়া যাবে।

তবে বিএনপির উচিত হবে রাজনীতিতে প্রশ্নের মুখোমুখি হয়, জনগণের নিকট দলের ইমেজ ক্ষুন্ন হয়, তৃণমূলের কর্মী সমর্থকেরা সাধারন মানুষের নিকট প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয় এমন কার্যক্রম থেকে নিজেদের বিরত রাখা। যেহেতু বিএনপি কিছুটা হলেও ব্যাকফুটে সেহেতু বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবীদের উচিত হবে সমকালিন সময়ের পরিস্থিতিকে আমলে নিয়ে দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে সামগ্রিক বিষয় সম্বন্ধে সম্যক ধারণা প্রদান করা। জনগণের মনের ভাষা বুঝে, জনগণের পাশাপাশি অবস্থান গ্রহণ করে, জনগণের চাহিদামাফিক কর্মসূচি ঘোষণা করে দলীয় কর্মীদের উজ্জীবিত করা হবে বিএনপির প্রকৃত কাজ। জনগণের সঙ্গে একাত্ন হয়ে জনগণকে সাথে নিয়ে বিএনপির কর্মসূচিতে যাওয়া উচিত। কিন্তু এর মানে এই নয়, ভিন্ন দলের কর্মসূচিতে হামলা করবেন কিংবা অন্য দলের উপর জমে থাকা ক্ষোভকে উদগিরণের অপচেষ্টা করবেন। বর্তমান সময়ে এসকল কর্মকান্ড সাধারণ মানুষের অপছন্দ, সে জন্যই এ ধরনের অস্থিতিশীল অপরাজনীতি পরিহার করে জনকল্যাণের নিমিত্তে কর্মসূচি প্রণয়ন করা উচিত। বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় হবে এ ধরনের কর্মসূচি কোনভাবেই দেশের জনগণ বরদাশত করবে না। দেশের জনগণও উন্নয়নের যাত্রায় শামিল, সে কারণেই উন্নয়নে বাঁধাগ্রস্থ হয় এমন কোনরূপ কর্মকে সাধারণ জনগণ সহজে মেনে নিবে না এবং বিএনপিরও এ পথ পরিহার করা উচিত।

আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশে বিএনপির হামলার অপচেষ্টা আসন্ন নির্বাচনকে বাঁধাগ্রস্থ করার একটি অপপ্রয়াস হিসেবে অনেকেই চিহ্নিত করেছেন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনকে ঘিরে ভোট কেন্দ্র পুড়ে দেওয়ার ঘটনা এবং দেশব্যাপী আগুন সন্ত্রাসে প্রাণ হারানোর নমুনায়ন বাংলাদেশের মানুষের অজানা নয়। বিএনপি নির্বাচন বয়কট করেছিল এবং নির্বাচনকে বাঁধাগ্রস্থ করতে দেশব্যাপী হরতাল অবরোধের ডাক দিয়ে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে ফেলেছিল। সাধারণ জনতা সে কথা ভুলে নি এবং পরবর্তীতে বিএনপির ডাকে কোন জনতাই সাড়া দেয়নি। সাধারণ জনতা কেন, বিএনপির ঘোষিত কর্মসূচি বিএনপির তৃণমূল বাস্তবায়নে তেমন সচেষ্ট নয়। দীর্ঘদিন ধরেই বিএনপির রাজনীতিতে তৃণমূলের সঙ্গে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের দূরত্ব নিয়ে সংবাদ গণমাধ্যমে এসেছে এবং এর প্রমাণ পরিলক্ষিত হয় বিএনপির ঘোষিত কর্মসূচির ফলাফল দেখে। কাজেই বিএনপির উচিত হবে জ্বালাও পোড়াও সংস্কৃতিতে নিবিষ্ট না হয়ে জনকল্যাণের স্বার্থে কর্মসূচি প্রদান করে জনগণকে তাদের সঙ্গে একাত্ন করে রাজপথের কর্মসূচি ঘোষণা করা। তৃণমূলের সঙ্গে শীর্ষ নেতৃত্বের দীর্ঘ দিনের বিরোধ মিটিয়ে দলীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে তৃণমূলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। বিএনপি এ পথে না হেঁটে দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশে হামলা করে প্রকৃতঅর্থে জনগণের কাছে আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে কি ধরনের বার্তা প্রদানে আগ্রহী সেটি বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বই উত্তর দিতে পারবে।

লেখক: সভাপতি, ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :