ব্রিটেন, গ্রেটব্রিটেন, ইংল্যান্ড, যুক্তরাজ্য নিয়ে বিভ্রান্তি

শাব্বির আহম্মদ
 | প্রকাশিত : ২৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:৪৯

ইউরোপ মহাদেশের মূল ভূখণ্ডের উত্তর পশ্চিমে আটলান্টিক মহাসাগরের ভেতরে পাশাপাশি দুটি বড় বড় দ্বীপ ও অনেকগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপ রয়েছে। বড় দ্বীপ দুটির মধ্যে যেটি বেশি বড় সেটির নাম ব্রিটেন আর অপেক্ষাকৃত ছোটটির নাম আয়ারল্যান্ড। ব্রিটেন দ্বীপটিতে আছে তিন জাতির তিনটি দেশ ইংল্যান্ড, ওয়েলস আর স্কটল্যান্ড। আগে এই তিনটি দেশ পৃথক পৃথক সাম্রাজ্যে বিভক্ত ছিল এবং তাদের পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহ লেগে ছিল অনেক কাল ধরে।

১৫৪২ সালে এসে ওয়েলস রাজ্য ইংল্যান্ড এর সাথে যুক্ত হয়ে ইংল্যান্ড-ওয়েলস সাম্রাজ্য নামে পরিচিতি পায়। অর্থাৎ এসময় এই ব্রিটেন দ্বীপে দুটি সাম্রাজ্য থাকল একটি ওয়েল- ইংল্যান্ড অপরটি স্কটল্যান্ড। পরে ১৭০৭ সালে এসে স্কটল্যান্ডও ইংল্যান্ড-ওয়েলস সাম্রাজ্যের সাথে একত্রে মিশে যাবার সিদ্ধান্ত নিল। ফলে ব্রিটেন দ্বীপে তিন জাতির তিন দেশ একত্রে মিলে একটি সাম্রাজ্যের সৃষ্টি হল। সে সময়ের সম্রাট জেমস ৬ষ্ঠ নিজেকে শুধু ব্রিটেনের রাজা পরিচয় দিতে চাইলেন না কারণ, তখন ব্রিটেন বলতে বোঝানো হতো রোমানদের প্রতিষ্ঠিত 'রোমান-ব্রিটানিয়া'কে যা কেবল ইংল্যান্ড আর ওয়েলস নিয়ে গঠিত হয়েছিল। যেহেতু তিনি এখন ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের সাথে অতিরিক্ত স্কটল্যান্ডেরও সম্রাট তাই তিনি নিজেকে "কিং অফ গ্রেট ব্রিটেন বা গ্রেটব্রিটেনের রাজা" পরিচয় দিতে শুরু করলেন। তার উত্তরসূরী সম্রাটগণও গর্বের সাথে তাকে অনুসরণ করলে গ্রেট ব্রিটেন নামটি প্রচলিত হয়ে যায়। তাছাড়া ১৭০৭ সালে পাশ হওয়া আ্যক্ট অব ইউনিয়ন আইনটিও গ্রেট ব্রিটেন নামটিকে প্রাতিষ্ঠানিকতা দেয়।

১৮০১ সালে এসে পাশের সেই অপর দ্বীপ আয়ারল্যান্ড এসে গ্রেটব্রিটেনের সাথে যুক্ত হয়। তখন এই চার দেশ অর্থাৎ ইংল্যান্ড, ওয়েলস, স্কটল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ড মিলে তৈরি হয় "দ্যা ইউনাইটেড কিংডম অফ গ্রেটব্রিটেন এন্ড আয়ারল্যান্ড"। ১৯৯২ সালে গণভোটে আয়ারল্যান্ডের উত্তর অংশের (ব্রিটেন এর গা-লাগানো অংশের ) ১৯ টি জেলা ব্যতীত বাকি বড় অংশের আয়ারল্যান্ড পৃথক হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করে। ফলে গ্রেটব্রিটেনের নাম সামান্য পরিবর্তিত হয়ে নতুন নাম হলো দ্য ইউনাইটেড কিংডম অফ গ্রেট ব্রিটেন এন্ড নর্থ আয়ারল্যান্ড। এরই সংক্ষিপ্ত রূপ ইউকে (ইউকে বা ইউনাইটেড কিংডম)। এই চার দেশের একসাথে যুক্ত হওয়ার আইনি নাম ইউনিয়ন। চার দেশ যখন একসাথে যুক্ত হয় তখন তাদের পতাকাও নতুন রূপে প্রকাশ পায়।

ব্রিটেনকে কেন ব্রিটেন বলা হয় আর ইংল্যান্ডের নামই বা ইংল্যান্ড হলো কেন? গ্রীকরা আজকের ফ্রান্সের দক্ষিণ উপকূলীয় এলাকা মার্সিলিতে তাদের সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিল। এই মার্সিলির অধিবাসী গ্রীক পরিব্রাজক ও জ্যোতির্বিদ পাইথিয়াস যিশু খ্রিস্টের জন্মের ৩২৫ বছর আগে উত্তর ইউরোপ ভ্রমণে বের হন। পাইথিয়াস-ই প্রথম ব্যক্তি যার কাছ থেকে আমরা প্রাচ্যবাসীরা প্রথম উত্তর মেরু, বরফের দেশ, নিশিত সূর্যের দেশ ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে পারি। তিনি ভ্রমণ করেছিলেন গ্রেটব্রিটেন ও আয়ারল্যান্ড।

পরবর্তী সময়ের গ্রীক লেখক স্ট্রাবো বলেছেন, পাইথিয়াসই দ্বীপটির নাম দিয়েছিলেন Pretannike পরবর্তীতে Latinদের কাছে তা হয়ে যায় Bretannike কারণ তারা শুরুর P উচ্চারণ করত না। পাইথিয়াস Pretannike কে ‘The land of pict বা land of the people of picture or people of form নাম দিয়েছিলেন। রোমান pict শব্দের অর্থ painted। অর্থাৎ রং করা মানুষ।‘ ধারনা করা হয় এই দ্বীপের 'রং করা মানুষ' বলতে সম্ভবত tatto করা মানুষকে বুঝানো হয়েছে অথবা যুদ্ধে যাওয়ার জন্য গায়ে রঙমাখা অথবা পাথরের রং থেকে এমন নামকরণ হতে পারে। এ নিয়ে বিস্তর তর্ক ও আলোচনা আছে ইতিহাসে।

তবে সাধারণভাবে ধরে নেওয়া হয় যে পাইথিয়াসের দেয়া Pretanike থেকে ল্যাটিন Bretannike থেকে ব্রিটেন নামকরণ হয়েছে। পরে অবশ্য রোমানরা এদ্বীপকে সরাসরি ব্রিটানিয়া নামেই ডাকতো। আর গ্রীকদের বলা Albion সম্ভবত আইরিসদের কে উদ্দেশ্য করে বলা হতো। অবশ্য এনসাইক্লোপেডিয়াতে বলা হয়েছে ব্রিটানিকায় Albion নামটি প্রাচীন ফ্রান্স Gaulদের কাছ থেকে নেয়া যার অর্থ white land আবার Latin Albus হতেও নেয়া হতে পারে যার অর্থ white। ব্রিটেন নামের উৎস নিয়ে এতোটুকুই সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য মত।

অন্যদিকে ইংল্যান্ড নামটির উৎস অপেক্ষাকৃত নবীন। রোমানদের পরে জার্মানির Anglen ও Saxony এলাকার মানুষ যারা Anglo-saxon বলে পরিচিত তারা Bretain এ বসতি গড়ে তোলে এবং old English এ কথা বলতো। এ ভাষায় Britain কে বলা হচ্ছে Engla land বা land of Angles. এই Angles রাই হলেন Anglo.অর্থাৎ Britain এ পরবর্তীতে বসতি গড়া জার্মান উপজাতীয় Angles দের নাম থেকে Engla land এবং তা থেকে England নামটির উৎপত্তি।

যুক্তরাজ্য বা ইউনাইটেড কিংডম একটি সার্বভৌম ভূখণ্ড, যার মধ্যে ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ওয়েলস এবং নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড অন্তর্ভুক্ত। চারটি দেশ মিলে একটি সার্বভৌম দেশ, যার রাজধানী আবার ইংল্যান্ডের রাজধানী লন্ডনে।

গ্রেট ব্রিটেন কোনো দেশ নয়। এটি ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের একটি সর্ববৃহৎ দ্বীপ। যুক্তরাজ্যের নর্দান আয়ারল্যান্ড বাদে বাকি তিন দেশের অখণ্ড অংশ নিয়ে গ্রেট ব্রিটেন গঠিত।

ইংল্যান্ড যুক্তরাজ্যের অন্তর্গত চারটি দেশের মধ্যে একটি দেশ। কিন্তু দেশটি সার্বভৌম দেশ নয়।

প্রশ্ন হলো ৪ জাতি ও দেশের সমন্বয়ে তৈরি হওয়া United kingdom of Great Britain and North Ireland বা UK এর রাজধানী, পাসপোর্ট, পার্লামেনট ইত্যাদি কী একটিই নাকি ভিন্ন ভিন্ন? আবার ব্রিটেন যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে গেল (Brexit= Britain Exit) গত ২০২০ সালের ৩১ জানুয়ারি, তাহলে কী সবাই EU এর সদস্য থেকে খারিজ হয়ে গেল?

সহজ উত্তর হলো United kingdom বা ৪ দেশের সম্মিলিত একক দেশ হিসাবে EU এর সদস্য হয়েছিল কাজেই বের হয়ে যাওয়ার ফলে কেউ আর ইইউ এর সদস্য নয়। তবে রাজধানীর ক্ষেত্রে একটু ব্যতিক্রম আছে। ইংল্যাণ্ডের রাজধানী লন্ডন সমগ্র UK-এরও রাজধানী। বাকি ৩টি রাজ্যের আলাদা রাজধানী আছে যেমন স্কটল্যান্ডের রাজধানী এডিনবরা, ওয়েলসের রাজধানী কার্ডিফ আর নর্থ আয়ারল্যান্ডের রাজধানী হলো বেলফাস্ট। Prime Minister বা প্রধানমন্ত্রী পদটি সমগ্র UK (যুক্তরাজ্য)-এর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যেমন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক UK-এর প্রধানমন্ত্রী অর্থাৎ তিনি ইংল্যাণ্ড, স্কটল্যান্ড, ওয়েলেস, আর নর্থআয়ারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী। আর ইংল্যান্ড বাদে বাকী তিন রাজ্যর আলাদা আঞ্চলিক সরকার ও পার্লামেনট (Local Assembly) আছে। যারা রাজ্যর আঞ্চলিক বিষয়াবলি দেখাশুনা করেন। আঞ্চলিক সরকারের প্রধানকে বলা হয় First Minister.।

উল্লেখ্য, ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড এবং ওয়েলস থেকে সবাই ব্রিটিশ, কিন্তু উত্তর আয়ারল্যান্ডের মানুষ যারা আইরিশ (এমনকি ইউ কে নাগরিকদের সত্ত্বেও) তারা ব্রিটিশ নয়। আয়ারল্যান্ড প্রজাতন্ত্র এর অধিবাসীরা শুধুমাত্র আইরিশ। এবং একমাত্র ইংল্যান্ডের জনগণকে বলা হয় ইংরেজ। অনেকে শুধু ইংল্যান্ডকেই যুক্তরাজ্য ভেবে ভুল করে থাকেন। কারণ যে চারটি দেশ নিয়ে যুক্তরাজ্য গঠিত, তার মধ্যে ইংল্যান্ড আয়তন এবং জনসংখ্যার দিক দিয়ে বাকি তিনটি দেশের চাইতে বড়। লন্ডন হলো যুক্তরাজ্যের রাজধানী, যা আবার ইংল্যান্ডেরও রাজধানী! ইংল্যান্ড ছাড়াও যুক্তরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত স্কটল্যান্ড, ওয়েলস এবং নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড- এই তিনটি দেশেরই আলাদা আলাদা পতাকা, রাজধানী, সরকার ব্যবস্থা, নির্বাচনী ব্যবস্থা এবং সংসদীয় ব্যবস্থাও রয়েছে।

(ঢাকাটাইমস/২৭ ডিসেম্বর/আরজেড)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফিচার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

ফিচার এর সর্বশেষ

ত্বকের হারানো জেল্লা ফিরিয়ে দিতে পারে ডাবের পানি!

ডায়াবেটিস রোগীর জন্য নিমপাতা মহৌষধ! জানুন খাওয়ার নিয়ম

ক্যানসার-ডায়াবেটিসসহ বহু জটিল রোগের মোক্ষম দাওয়াই আখের রস

এই গরমে কেমন তাপমাত্রার পানিতে গোসল করলে শরীর থাকে চাঙ্গা?

পাইলসের মতো যন্ত্রণায়ক সমস্যা থেকে মুক্তি দেয় যে পাঁচ ফল

হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমাতে হাঁটার চেয়ে বেশি কার্যকর সিঁড়ি ভাঙা

গরমে তৃষ্ণা পেলেই ঠান্ডা পানি খান? বিপদের কিন্তু শেষ থাকবে না

ঘুমের মধ্যে মুখ হাঁ হয়ে যায়? কী ভয়ানক বিপদ হতে পারে জানুন

যেসব খাবার রাতে খেলে ঘুমের মারাত্মক সমস্যা হতে পারে

সকালের নাস্তায় কী খাবেন কী নয়? লাভ-ক্ষতিসহ জানুন সবিস্তারে

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :