কবি কামাল চৌধুরী: জন্মদিনের শুভেচ্ছাঞ্জলি

আবদুল্লাহ আল মোহন
 | প্রকাশিত : ২৮ জানুয়ারি ২০২৪, ১৩:৫৪

সত্তর দশকের স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর, অন্যতম কবি, প্রেম ও দ্রোহের কবি কামাল চৌধুরী। যার কাছে ‘কবিতা হাড়ের মধ্যে রাত জাগে’। বর্তমান সময়ের বাংলা কবিতার একজন অন্যতম জনপ্রিয় কবি এবং বাগ্মী কামাল চৌধুরী। কামাল আবদুল নাসের চৌধুরীর লেখক নাম কামাল চৌধুরী। ‘মিছিলের সমান বয়সী’খ্যাত এই কবি শুরু থেকেই নিমগ্ন নিজস্ব কাব্যভাষা নির্মাণে। সমকালীন বাংলা কবিতার জগতে কামাল চৌধুরীকে ‘মুখ্য’ কবি বলেছেন তার অগ্রজ বেশ কয়েকজন কবি। শৈল্পিক মান বজায় রেখে রাজনৈতিক আদর্শ সম্বলিত কামাল চৌধুরীর ছন্দময় কবিতায় সৃষ্টিশীলতার ধারা রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন তারা।

স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে প্রকাশিত ‘কণ্ঠস্বর’ পত্রিকার সম্পাদক, সরাসরি শিক্ষক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তার এই ছাত্র কবিকে নিয়ে প্রথম সংখ্যাতেই লিখেছিলেন- ‘খুব স্পষ্টভাবে অনুভবগণ্য না হলেও আমরা, নিকটতরেরা অনুভব করছি আমাদের সাহিত্য গত দশকের (ষাটের) বিক্ষিপ্ত, অস্থির ও লক্ষ্যহীন মানসিকতার পর্যায় ছেড়ে, অন্ধকার বন্দনার ক্লেদাক্ত পাপ ও পচন থেকে এবং আকাশব্যাপী নৈরাজ্য, বিভ্রান্তি ও অর্থহীনতার আবর্ত থেকে মুক্তি নিয়ে সুস্থ ও সংহত এক অম্লান জীবনাগ্রহে জেগে উঠছে।’ এই সৃষ্টিশীলতা ও আশার অভ্রান্ত অভিজ্ঞান কামাল চৌধুরী। আর কবি কামাল চৌধুরী বলছেন, ‘আমি সময় সময় কবিতার পথে একজন অতৃপ্ত পথিক হিসেবে থাকতে চাই। আমি যদি পাঠকের ভালোবাসা পাই সেটাই হবে আমার শ্রেষ্ঠ জয়মাল্য।’ তিনি ১৯৫৭ সালের ২৮শে জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রাক্তন মুখ্যসচিব, বর্তমানে শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা (মন্ত্রীর মর্যাদায়) এবং শ্রদ্ধেয় কবি কামাল চৌধুরী, আমাদের সুপ্রিয় স্বজনকে জন্মদিনে নিরন্তর শুভেচ্ছা, বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।

কামাল চৌধুরীর কবিতায় জনস্রোত, ক্ষোভ, দ্রোহ, মনোবেদনা, আকাক্সক্ষার উচ্চারণ হয়েছে বলে স্বীকার করেন সমালোচকগণ। ‘কবিতা কী? নানা বির্বতনের মধ্য দিয়ে কবিতার অবস্থান কোথায়? কবিতা কবির শ্রম, ঘাম, মেধা খেয়ে বেড়ে উঠা নন্দগোপাল। এখনও এই যান্ত্রিক সময়ে প্রকৃত কবিতা পাঠকের গা ঘেঁষে দণ্ডায়মান। প্রকৃত কবিতা কী? নানা মতবাদে না গিয়ে বলব যে কবিতা পাঠকের মনোচক্ষু সিক্ত করে তাই প্রকৃত কবিতা।’ আর তাই দেখি, মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী যে কয়েকজন কবি নিজস্ব শিল্প-কুশলতায় নিজেকে বাংলা কবিতার নান্দনিক ধারার সঙ্গে যুক্ত করতে পেরেছেন, তাদের মধ্যে কবি কামাল চৌধুরী অন্যতম নিঃসন্দেহে। ‘মিছিলের সমান বয়সী’ কবি কামাল চৌধুরী সত্তর পরবর্তী সময়ের সাহস জাগানিয়া কবি। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, কামাল চৌধুরী, মোহন রায়হানরা যে প্রদীপ জ্বালিয়েছিলেন সেটাই কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের উত্তর প্রজন্মের চেতনা। খুব আশার কথা কামাল চৌধুরী শেষ পর্যন্ত মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-প্রবাহ তার কবিতায় সমুজ্জ্বল রেখেছেন। জনমানুষের ক্রোধ ও বেদনা মন্থনের যুগল অভিব্যক্তি নিয়ে তার কবিতা চিহ্নিত। তাঁর কবিতায় এমন এক মহিমা উদ্ভাসিত, যা ক্রোধের বিস্ফোরক, কিন্তু ধ্বংসী নয়। তার কবিতায় পাওয়া যায় এক মায়াময় আলেখ্য। কিন্তু এই আলেখ্য কোমলে কোমলে বিগলিত নয়। এসবের মিথস্ক্রিয়ায় যে শিল্পস্বর উঠে আসে তা প্রতিবাদী, কিন্তু উচ্চকণ্ঠী নয়। এভাবে তিনি সত্তরের সবচেয়ে ব্যতিক্রমী কবি হয়ে ওঠেন। স্বনামধন্য ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটনের ভাষায় বলতে হয়, ‘কিন্তু হাইব্রিড এসব বঙ্গবন্ধুপ্রেমীর ভিড়েও প্রকৃত মুজিবপ্রেমী কামাল চৌধুরীকে আলাদাভাবে শনাক্ত করা যায়। নিজের মেধা ও যোগ্যতায় কামাল চৌধুরী আজ সরকারের নীতিনির্ধারকদের একজন। কামাল চৌধুরীর মতো কবিরা সরকারের উচ্চাসনে থাকলে দেশের সাধারণ মানুষ আশাবাদী হয়ে ওঠেন। কারণ একজন কবি যখন আমলা হন, তখন নিষ্ঠুর আমলাতন্ত্র কিছুটা হলেও মানবিক হয়ে ওঠে। দেশকে গড়ে তোলার পরিকল্পনা গ্রহণ এবং বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দেশের সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট-হতাশা আর স্বপ্নকে সঠিকভাবে অনুভব ও অনুধাবন করতে পারে একটি কবি-হৃদয়। আমরা জানি, আমলা কামাল চৌধুরীর কবি-হৃদয় দেশ ও মানুষের জন্য ভালোবাসায় পরিপূর্ণ।’

কামাল চৌধুরীর ছন্দময় কবিতা পড়ে খুব ভালো লাগে বলে জানিয়েছেন প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। মন্ত্রিসভা বৈঠকে অনেক সময়ই কামাল চৌধুরীর উপস্থিতির স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেছেন- ‘মন্ত্রিসভা বৈঠকে যখন কোনো বানান, উচ্চারণ বা শব্দ নিয়ে কোনো সমস্যা হয় তখন আমরা কামাল চৌধুরীকে ডাকি, সে হলো ডাক্তার। সে বলে, কোনটা ঠিক কোনটা বেঠিক। প্রধানমন্ত্রীও বলেন, ‘ওখান থেকে (কামাল চৌধুরী) জেনে নেই এটা ঠিক হলো কি না?’ কামাল চৌধুরীকে গুরুত্বপূর্ণ কবি অভিহিত করে প্রাক্তন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেছেন- ‘উনি আমলা কামাল নয়, কবিতার কামলা কামাল।’ চার দশক আগে তরুণ কবি কামাল চৌধুরীকে দেখার স্মৃতি আওড়ে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা বলেছেন- ‘৪০ বছর আগে এই বাংলা একাডেমিতে একজন তরুণ সিঁড়ি বেয়ে প্রেস বিল্ডিংয়ের তেতলায় এসে একটি ছেঁড়াখোড়া পাতা আমার হাতে দিয়ে বলেছিল, রুদ্র আমাকে পাঠিয়েছে আপনার কাছে এই কবিতাটা দেওয়ার জন্য, বলেছেন এটা দেখবেন। আমি উল্টে-পাল্টে দেখার আগেই একটি চড়ুই পাখির মতো সে উড়ে গেল। দেখার পর মনে হয় কবি তো উড়ে গেল, এই কবিতার পাতাটি তো উড়ে গেল না, এটা থেকে যাবে।’ কামাল চৌধুরীকে নিজের পরবর্তী প্রজন্মের কবি হিসেবে ‘সম্মান ও শ্রদ্ধা’ জানিয়ে নূরুল হুদা আরো বলেন, ‘কবি কামাল চৌধুরীকে নয়, তার কবিতা, তার সৃষ্টিশীলতার ধারাকে, সৃষ্টিশীলতার ব্রহ্মপুত্রকে, সৃষ্টিশীলতার যমুনাকে উদ্যাপন করছি। ভয়ের কোনো কারণ নেই, শঙ্কার কোনো কারণ নেই, তাকে শনাক্ত করার সাহস আমাদের দরকার।’ সমকালীন বাংলা কবিতায় কামাল চৌধুরীকে ‘মুখ্য’ কবি বলেছেন নুরুল হুদা। বাংলা একাডেমির প্রাক্তন মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বলেছিলেন, ‘তার কবিতাগুলোকে স্নেহসিক্ত, কান্নাভেজা, রুদ্ররোষে বিস্ফোরিত মনে হয়।’ লেখক ইমদাদুল হক মিলন বলেছেন, ‘আমি যদি কামালের একটি কবিতার দুটো লাইন লিখতে পারতাম তাহলে আমার লেখক জীবন ধন্য হতো। তার কবিতার প্রতিটি লাইনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা দেখতে পাই।’ নজরুল গবেষক জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘এই কবি আমাদের অনেক দিয়েছেন। একটি দেশ পরিচিত হয় তার কবিতা দিয়ে, সাহিত্য দিয়ে, শিল্পপতিদের দিয়ে নয়।’ নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, ‘একজন শিল্পীর জীবনে যে রাজনৈতিক ও শিল্প আদর্শ থাকা দরকার তা কামালের কবিতায় আছে।’

সত্তরের মাঝামাঝি তারুণ্যদীপ্ত ও দ্রোহী কবিতা নিয়ে কাব্যজগতে প্রবেশ করেন কবি কামাল চৌধুরী। ১৯৮১’র বাংলা একাডেমি বইমেলাকে উপলক্ষ্য করে এক দল তরুণ কবি জীবনের প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কামাল চৌধুরী তাদেরই একজন। একুশের সেই বইমেলাতেই বেরিয়েছিল তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘মিছিলের সমান বয়সী’। ‘যযাতি’ কবিতায় সুধীন্দ্রনাথ দত্ত নিজেকে বলেছিলেন ‘আমি বিংশ শতাব্দীর সমান বয়সী...’; অন্যদিকে কামাল চৌধুরী নিজেকে দেখেছেন ‘মিছিলের সমান বয়সী' রূপে। এই মিছিল ১৯৮০'র দশকের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে অবিনাশী দ্রোহের প্রতীক। তিনি নিজেকে মিছিলের পক্ষের হিসেবে যেমন চিহ্নিত করেছেন, তেমনি মিছিলের বিপক্ষে যারা তাদের বিষাক্ত নিঃশ্বাস রুদ্ধ করে দেওয়ার আকাক্সক্ষা স্পষ্টস্বরে ব্যক্ত করেছেন। একই সঙ্গে নতুনভাবে সমাজকে বিন্যস্ত করার রোমান্টিক প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন তরুণ কবি। কামাল চৌধুরীর অন্যতম প্রেরণা সমাজচিন্তা ও তৎসঞ্জাত দ্রোহ এই কবিতার জন্ম দিয়েছে। এই সমাজ সচেতনতা, এই দ্রোহ, এই অনন্যতান্ত্রিক সংস্কারবোধ আনুপূর্ব তার কাব্যচেতনার অন্যতম চারিত্র্যলক্ষণ। বহু কবিতায় সমাজ নানা প্রশ্ন নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। জীবনযাপনের কোলাহলের ভেতরেও কবিতাই তার সাধনা। বিচ্ছিন্নভাবে কিছু গদ্য লিখেছেন, সেটাও কবিতা বিষয়ক। কবিতার বাইরে উৎসাহী সমাজ-সংস্কৃতি অধ্যয়ন ও গবেষণায়।

শক্তিমান এ কবির লেখালিখির হাতেখড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায়। নিয়মিত লিখছেন সত্তর দশক থেকে। ১৯৭৪ সালে দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাতায় কবিতা প্রকাশের মাধ্যমে সমকালীন কাব্যজগতে প্রবেশ তার। ব্যস্ততম সরকারি চাকুরে হলেও কবিতার জন্য ঠিকই সময় বের করে নেন তিনি। তা সেটা যানজটে আটকা পড়া গাড়িতে বসেই হোক কিংবা বিদেশ ভ্রমণের উদ্দেশে আকাশযানে হোক। কবিতার স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক কাজের পাশাপাশি ইউনেস্কো নির্বাহী বোর্ডে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবেও কাজ করছেন তিনি। উল্লেখযোগ্য কবিতাগ্রন্থ: ‘মিছিলের সমান বয়সী’, ‘টানাপোড়েনের দিন’, ‘এই পথ এই কোলাহল’, ‘এই মেঘ বিদ্যুতে ভরা’ ‘ভ্রমণকাহিনী’ ইত্যাদি। কবি হিসেবে তিনি ২০১১ সালের বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ভারতের কলকাতার সৌহার্দ্য সম্মাননা (২০০৩) ও আসাম বিশ্ববিদ্যালয় সম্মাননাসহ (২০১১) বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন। শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি বাংলা একাডেমির ফেলো এবং বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির আজীবন সদস্যের স্বীকৃতি পেয়েছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্‌যাপন জাতীয় কমিটির প্রধান সমন্বয়ক ছিলেন কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী।

কামাল চৌধুরীর জন্ম হয়েছিল কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার বিজয়করা গ্রামে। বাবা আহমদ হোসেন চৌধুরী ও মা বেগম তাহেরা হোসেনের ছয় সন্তানের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাসের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্মাতাল জীবন। এখানেই কাব্যলক্ষ্মীর কাছে চিরসমর্পণ; এখানেই রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহসহ সমসাময়িক কবিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা; এখানেই ‘কবিতা পথিক’ হিসেবে অভিষেক; এখানেই কবিতার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য গাঁটছড়া। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে ১৯৭৮ সালে স্নাতক (সম্মান), ১৯৭৯ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি এবং ২০০৬ সালে নৃ-বিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের পর বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে যোগদান। ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দে সরকারি চাকরির ফাঁকে নৃবিজ্ঞানে পিএইচডিটা সেরে ফেলেন। গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল: ‘গারো জনগোষ্ঠীর মাতৃসূত্রীয় আবাস প্রথা’। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউট ও ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্যের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়, সিঙ্গাপুর সিভিল সার্ভিস কলেজ, ওয়াশিংটন ডিসি'তে অবস্থিত বিশ্বব্যাংক ইনস্টিটিউট, ইরানের তেহরানস্থ আইসেস্কো আঞ্চলিক কার্যালয় এবং অস্ট্রেলিয়ান কাউন্সিল ফর এডুকেশন রিসার্চ (এসিইআর) মেলবোর্নসহ অস্ট্রেলিয়ায় পেশাগত বিভিন্ন প্রশিক্ষণ লাভ করেন তিনি। কামাল চৌধুরী বিবাহিত ও ২ সন্তানের জনক।

১৯৮২ সালের বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৮৩ সালে বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারে সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন। চাকরি-জীবনে তিনি মাঠ পর্যায়ে ম্যাজিস্ট্রেট, সহকারী কমিশনার, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ও জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সালে উপ-সচিব পদে পদোন্নতি পেয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যোগদান করেন। ২০০২ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত তিনি শেরপুর জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৭ সালে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব হিসেবে যোগদান করে ২০০৮ সালে অতিরিক্ত সচিব এবং ২০১০ সালে সরকারের সচিব পদে পদোন্নতি পান। তিনি ৩০শে জুন ২০০৯ হতে ভারপ্রাপ্ত তথ্য সচিব ও পরবর্তীতে পূর্ণ সচিব হিসেবে ২০শে অক্টোবর ২০১০ পর্যন্ত তথ্য মন্ত্রণালয়ে, ২১শে অক্টোবর ২০১০ হতে ১২ই ফেব্রুয়ারি ২০১৪ পর্যন্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং ১৩ই ফেব্রুয়ারি ২০১৪ হতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৪ সালের ১৯শে মার্চ তারিখে তিনি সরকারের সিনিয়র সচিব পদে পদোন্নতি পান। দেশি ও বিদেশি অনেক পেশাজীবী ও শিক্ষা-সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থার সাথে তিনি সক্রিয়ভাবে জড়িত আছেন। এর মধ্যে প্যারিসে অবস্থিত ইউনেস্কোর নির্বাহী বোর্ডে বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধি, বিসিএস অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস এসোসিয়েশনের সভাপতিসহ বর্তমানে তিনি অনেকগুলো সংস্থায় সভাপতি ও সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। একই সঙ্গে তিনি ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি (আইইউটি)-এর পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান আইসেসকো’র কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য, জাতীয় পাঠ্যক্রম সমন্বয় কমিটির সভাপতি, বাংলাদেশ ফিল্ম সেন্সর বোর্ড ও বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন-এর চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।

কামাল চৌধুরী উদার মানবতাবাদে গভীরভাবে বিশ্বাসী কবি। তাঁর কবিতায় মানবতবাদী সুর প্রবল, তবে তা প্রগলভ নয়। আধুনিক কবি হয়েও তিনি শিল্পের অমানবিকীকরণ তত্ত্বে গা ভাসিয়ে দেননি। নিবিড়ভাবে মানবতাবাদী এই কবি বলেছেন- ‘হানাহানি, রক্তপাত- একবিশ্বে বিভক্ত পৃথিবী/কবি তার অংশ নয়- তার নাম চিরমুক্ত পাখি/জন্ম যদি চুরুলিয়া মৃত্যু তবে ঢাকার মাটিতে/কবিকে রুখতে পারে এরকম কাঁটাতার নেই।’ যা কিছু পৃথিবীর জন্য কল্যাণকর, যা সুন্দর জীবনের জন্য অত্যাবশ্যক, তার পক্ষাবলম্বনে আগাগোড়াই দ্বিধাহীন তার মন ও কলম। এক শুভবাদী রোদ-জোছনার মিছিল কামাল চৌধুরীর কবিতা যা দেখে পিছুহটে জীবনের যাবতীয় অশুভ অন্ধকার। শুভবাদী ঘোষণায় তিনি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ জন্মের কাছে, জন্মভূমির কাছে, পৃথিবীর কাছে। কবিতা লেখা সম্পর্কে কামাল চৌধুরী বলেন, ‘একটা জীবন সাত-পাঁচ না ভেবেই কাটিয়ে দিয়েছি কবিতার জন্য।’ ঘনিষ্ঠ পাঠক জানেন কামাল চৌধুরীর জীবন ও মনন জুড়ে রয়েছে কবিতার মোহময় প্রতিপত্তি; রাজনীতি ও আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার পঙ্কিলতা অগ্রাহ্য করে তার মানবিক কবিসত্তা অটুট রয়েছে। কবিতাই তার জীবনরীতির প্রধান উপচার, জীবনের প্রধান শাসক, নিয়ামক। তার ব্যক্তিত্ব নম্রতায় আচ্ছাদিত; শুদ্ধ কবির মতোই তার জীবনাচার।

কবি কামাল চৌধুরী মনে করেন, বাংলা ভাষাভাষী অনেক কবি বিশ্বমানের কবিতা লিখছেন, কিন্তু তা বিশ্বসাহিত্যে পৌঁছুতে পারছে না ভাষাগত কারণে। অনুবাদ করলেই যে কবিতার মৌলিকতা রক্ষা হবে, তা কিন্তু নয়। তাই অনুবাদ-নির্ভর হওয়া যাচ্ছে না। তিনি আরও বলছেন, আমাদের কবিতার ভালো সমালোচক নেই। বই বের হচ্ছে সম্পাদনা ছাড়াই। কবিতা সম্পর্কেও তিনি বলেছেন, কবিতা শিক্ষক বা সমালোচকদের কাছে টেক্সট হয়ে যায়। কিন্তু টেক্সট কবিতা নয়, কবিরা এসব নিয়ে ভাবেন না। শব্দে ছন্দে স্মৃতিময়তার ভেতর ঢুকে গেলেই একজন কবি সার্থক হন। বাংলা কবিতার গতিধারা সম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে কবি কামাল চৌধুরী বলেন- ‘তিরিশের দশকে কবিতার ক্ষেত্রে যে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়, যা হয় বেশ সমন্বিতভাবে। কিন্তু পঞ্চাশে এসে বলতে পারছি না সেটা বাদ দিয়ে দিতে। পঞ্চাশে এসে কিছু কিছু কবি নতুন কবিতা লিখেছেন, ষাটে এসেও নতুন কবিতা লিখেছেন। কিন্তু কবিতার যে পালাবদল সেই জায়গাটি এখনও তৈরি হয়নি। ক্রিয়াপদ বাদ দিয়ে শুধু উপমা বসিয়ে দিয়ে কবিতা লেখার পরীক্ষা নিরীক্ষা আমিও একসময় করেছি।’

বিদগ্ধজনের মূল্যায়নে কামাল চৌধুরীর কবিতার আসল বিষয় যে মুক্তিযুদ্ধ, সেই মুক্তিযুদ্ধের দর্শনই তার জীবনদর্শন, তার সেই দর্শনই হয়েছে এই সময়কার সমস্যা-সংকটের গ্রন্থিমোচনের আয়ুধ। সেই আয়ুধের প্রয়োগেই তিনি কৃতজ্ঞদের মুখোশ উন্মোচন করেন, ওদের স্মরণ করিয়ে দেন, ‘আমরা মুজিবের লোক/আমাদের বারুদগন্ধ মিশে আছে পতাকার রঙে/ত্যাগ ও মহিমা ভাষায়/যে যুদ্ধ ভালোবাসাবৎ/সেখানে পরাজয় নেই/সেখানে বিজয়ী জাতির রক্তে প্রতিদিন ভোর আসে/প্রতিদিন সূর্যোদয়ে/আত্মসমর্পণ করে হানাদার।’ কামাল চৌধুরীর কবিতার, বিশেষত তার স্বদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কবিতার অন্তর্নিহিত বহুমাত্রিকতা অনেক ক্ষেত্রেই এই ভূ-নৃতাত্ত্বিক আত্মসচেতনতার গভীরতার মধ্যে নিহিত। এই উপাদান বা বৈশিষ্ট্যের পরিকল্পিত এবং পুনরাবৃত্ত উপস্থিতি একই ধরনের অন্যান্য বাংলা কবিতায় পাওয়া যায় না, বাংলাদেশের অন্যান্য কবির কবিতাতেও এই বৈশিষ্ট্য এমন কেন্দ্রীয় গুরুত্ব পায়নি। অনুমিতভাবেই, সমাজবিজ্ঞান ও নৃবিজ্ঞান বিষয়ে কামাল চৌধুরীর প্রাতিষ্ঠানিক অধ্যয়ন ও আগ্রহ এই গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় রসায়নের উৎসস্থল হিসেবে কাজ করেছে। জীবনকাব্য রসের নান্দনিক উপস্থাপক হিসেবে, স্বদেশের জল মাটির কবি কামাল চৌধুরী হয়ে উঠেছেন আমাদের আনন্দের উৎস, শিল্প চেতনার অনুঘটক। আবারো নিরন্তর অভিনন্দন ও শুভকামনা- প্রিয় কবি আপনাকে, জন্মদিনে।

আবদুল্লাহ আল মোহন: লেখক, গবেষক ও সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ভাসানটেক সরকারি কলেজ, ঢাকা

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :