হিমের উষ্ণতা
আমারও একজন প্রেমিকা আছে;
যেমন সকলেরই থাকে বাস্তবে কিংবা কল্পনায়,
পারমিতাও তেমনি থাকে আমার ভাবের রঙ-তুলিতে আঁকা
রঙবেরঙের আলপনায়, আমার কবিতার উপমায়।
পার্বতীকে যেমন দেবদাস ‘পারো’ বলে ডাকতো,
আমিও আমার পারমিতা’র আদুরে নাম দিয়েছি ‘প্রীতি’।
ও আমার বৃষ্টি বালিকা, অনুরাগের শিখা, মেঘ মল্লিকা,
আমার গল্পের ভূমিকা, আখ্যানভাগ, উপসংহার, পাদটীকা।
যজ্ঞের অগ্নি থেকে যেমন দ্রুপদ রাজের কন্যা দ্রৌপদির জন্ম,
তেমনি আমার প্রিতমার জন্ম কালা-মেঘির উদর থেকে।
জলের নূপুর পায়ে ঝুমুর ঝুমুর ছন্দতালে
কালের চক্রে বর্ষার পুষ্পরথের সোয়ারি হয়ে
গাছের ডালে, টিনের চালে, শাপলা বিলে,
খাগড়াবনের শুকনো খালে, নদ-নদীদের খাঁখাঁ বুকে, বন-বনানীর বৃক্ষপাতায়, লজ্জাবতীর লতায় লতায়,
বাদলা দিনের কদম ফুলে, চপল পায়ের চিহ্ন এঁকে ভরা কলস কাঁখে ধরে, রাণির মতো হেলে-দুলে
শান বাঁধানো দিঘির ঘাটে আমার গায়ের বাঁ-পাশ ঘেঁষে
উদাসী এক দৃষ্টি মেলে,হিম-হিমেলি এলো চুলে,
দমতোলা তার শ্বাসটা টেনে ধপাস কর বসে পড়ে।
গুটায় আমার নিরুদ্দেশে ছড়ানো জাল,
ছন্দপতন ঘটে আমার কাব্য-গাথায়।
দিগন্ত জুড়ে নাচতে থাকা আমার মতির জ্যোতি টুটতে থাকে,
লক্ষ-কোটি তারার ফুল, জোনাক সোনাদের নাচানাচি উবে যায়।
অবাক হয়ে বলি, ‘এখন এলে! কোথায় ছিলে প্রীতি’?
প্রীতি বলে,“বর্ষা এলে ফর্সা লাগে অতীত দিনের স্মৃতি,
অতীত নিয়ে হাঁটাই বুঝি বাঁচার-সংস্কৃতি।”
এরপর ওর পায়ের পায়েলের আওয়াজ শূন্যে মিলিয়ে যায়।
বৃষ্টিবালিকা যায় দৃষ্টির আড়ালে।
গোলক ধাঁধায় পড়ে যায় আমার চৈতন্য;
কে-বা পারমিতা, কে-বা বৃষ্টি বালিকা!
আড়াল থেকে কে উস্কে দেয় আমাদের ঘুমন্ত বোধ!
রক্ত সঞ্চালনে দেয় বেগের ক্ষিপ্রতা!
বুকের ধুকধুক থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে অপার শূন্যতা!
আলিঙ্গনের উষ্ণতায় আমরা দুজনেই হারিয়ে যাই সেই রাজ্যে-
যেখানে কেবলি বসন্ত কিংবা বর্ষার রাজত্ব।
সেখানে থরে থরে ফুটে থাকে স্বর্গের পারিজাত ফুল,
কদম কেয়া টগর লাল-গোলাপ আর চম্পা পারুল।
আমরা তখন একে একে একাকার;
অতীতকে করেছি বর্তমানের অংশিদার;
বর্তমানকে করেছি ভবিষ্যতের কর্ণধার।
যেমন করে পদ্মফুলের পাপড়িরা পাখনা মেলে ছন্দদোলায়-
তেমন করে ধীরে ধীরে আমাদের বাহুর বন্ধন শিথিল হয়;
দারুচিনি দ্বীপে এ যেন এক নতুন দিনের অভ্যুদয়।
আক্ষেপের ভারে আক্রান্ত হয় ভাবনা,
বৃষ্টি বালিকার দেখা আগে কেন মেলনি কখনো!
দুজনে মিলে কেন অহর্নিশ তাকে দিক-দিগন্তে খুঁজিনি!
বৃষ্টির হিমে এমন দুরন্ত উষ্ণতা থাকে
আগে কেন সে কথা বুঝিনি!
আমি বলি, উতলা হয়ো না পারমিতা!
সময়ের রথে চড়ে নিজের মর্জি মাফিকই আসে
কাঙ্খিত হিমের উষ্ণতা।