উন্নয়ন নেই বঙ্গবন্ধুর গড়া হাসপাতালে, ২০ চিকিৎসক দিয়ে ৬০০ রোগীর চিকিৎসা

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা টাইমস
| আপডেট : ০৯ নভেম্বর ২০২৩, ১২:১০ | প্রকাশিত : ০৯ নভেম্বর ২০২৩, ১১:৫০

রাজধানীর মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে এক কিলোমিটার দূরে সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল। ১৯৭২ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১০০ শয্যার হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠা করার পর আর সম্প্রসারণ করা হয়নি। আধুনিকতার বিন্দুমাত্র ছোঁয়া সেখানে লাগেনি। জানা গেছে, প্রতিদিন পাঁচশ থেকে ছয়শ জন রোগীর চিকিৎসা দিচ্ছেন মাত্র ২০ জন চিকিৎক। এত কম জনবল নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি রাতদিন মানুষকে সেবা দিয়ে যাচ্ছে। এতে হিমশিম খেতে হচ্ছে চিকিৎসকদের। হাসপাতালে সরজমিনে ঘুরে এ চিত্র দেখা যায়।

রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর থেকে এসেছেন শেফালী নামের এক মধ্য বয়সী নারী। তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, আমার পায়ে কুকুর আচড় দিয়েছে। তাই এখানে এসেছি চিকিৎসা নিতে। এর আগেও এখানে আমাদের এলাকার কয়েক রোগী এসেছিলেন চিকিৎসা নিতে। তাদের কাছ থেকে শুনেই এখানে এসেছি। এখানে ভালো চিকিৎসা পাচ্ছি। হাসপাতালের স্টাফদের আচরণও বেশ ভালো।’

হাসপাতালের জ্যেষ্ঠ সেবিকা বলেন, এখানে মূলত নিম্ন আয়ের মানুষেরাই চিকিৎসা নিতে আসেন। রাজধানীর মিরপুর, মোহাম্মদপুর, কামরাঙ্গীরচর, হাজারীবাগ এলাকা থেকে মানুষ আসেন। এছাড়াও গাজীপুর অঞ্চল থেকেও মানুষ আসেন। সারাদেশ থেকেই রোগী আসেন এই হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার জন্য।

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, মহাখালী সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে আগতদের মধ্যে কুকুর, বিড়াল ও শিয়ালের কামড় খাওয়া রোগীর সংখ্যাই বেশি। এছাড়া জন্ডিস, ধনুষ্টংকার, জলবসন্ত, ডিপথেরিয়া, এনফেলোকাইটিস, ভাইরাস হেপাটাইটিস, এআরভি ভ্যাকসিনের প্রতিক্রিয়া ঘটা রোগীরাও এখানে চিকিৎসা নিতে আসেন। এইচআইভির (এইডস) মতো মারাত্মক রোগীসহ নিউমোনিয়া, টাইফয়েড, হাম, মামস-জাতীয় রোগের চিকিৎসাও দেওয়া হয় এখানে।

তৌফিকুল ইসলাম নামের একটি চার বছরের শিশু এসেছে তার বাবা-মার সঙ্গে। শিশুটির বাবা জানান, তার ছেলেকে বিড়ালে আঁচড় দিয়েছে। তাই এখানে নিয়ে এসেছেন। চিকিৎসকের পরামর্শমমতো ছেলেকে টিকা দেওয়া হয়েছে।

হাসপাতালটির মেডিকেল অফিসার শ্রীবাস পাল ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘জলাতঙ্ক একটি মারণব্যাধি। এখনও পৃথিবীতে এ রোগের কোনো চিকিৎসা নেই। তার মানে ১০০ ভাগ রোগী মৃত্যুর ঝুঁকিতে থাকছেন।’

তিনি জানান, বাংলাদেশে পাঁচটি প্রাণির কামড়ে জলাতঙ্ক রোগ হতে পারে। কুকুর, বিড়াল, শেয়াল, বানর এবং বেজি। তাই এসব প্রাণি থেকে সবার সাবধান থাকার ওপর তিনি গুরুত্ব আরোপ করেন তিনি।

২০১০ সালের আগে এ দেশে প্রতিবছর দুই হাজার জনের বেশি মানুষ মারা যেত। সরকার ২০১০ সালে জাতীয় জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কর্মসূচি হাতে নেয়। এই কর্মসূচি নেয়ার আগে ঢাকা সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালকে নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কর্মসূচি কেন্দ্র করা হয়। এরপর থেকে এই হাসপাতালে ছুটির দিনসহ প্রতিদিন ২৪ ঘণ্টা প্রাণির কামড়ের চিকিৎসা দেয়া হয়।

তিনি বলেন, ‘কুকুড়, বিড়াল, শেয়াল, বানর এবং বেজির কামড়ে বা আঘাতে সেখান থেকে রক্তক্ষরণ হলে, চামড়াতে ঘা হলে সঙ্গে সঙ্গে আমাদের হাসúাতালে আসতে হবে। আমরা রোগের ধরন বিবেচনা করে তিন ধরনের চিকিৎসা দিয়ে থাকি। প্রথমত রোগী এখানে আসার পরে কাপড় কাঁচার সাবান দিয়ে ক্ষতস্থান ধুয়ে নিতে হয়, সব কামড়ের জায়গায় দুই হাতে টিকা এবং ক্ষত জায়গায় টিকা। কোনো কোনো রোগীকে শুধু টিকা দেওয়া হয়।’

তিনি বলেন, ‘জাতীয় জলাতঙ্ক কর্মসূচি চালু করে অনেকাংশে কমে গেছে। সবশেষ ২০২০ সালে এটি ২৬ এর কোটায় নেমে আছে। এই পাঁচ প্রাণীর কামড়ের চিকিৎসা না নিলে জলাতঙ্ক হবে। এ রোগ থেকে বাঁচানো যায় না। এখানে ১০ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে চিকিৎসা নেয়া যায়।’

ডা. শ্রীবাস পাল বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালের বহির্বিভাগের প্রতিদিন প্রাণির কামড়ে আহত হয়ে পাঁচশ থেকে ছয়শ রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন। আর জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতি বছরে ৩০ থেকে ৩৫ জন রোগী ভর্তি হয়। এছাড়াও কোনো মাসে দুয়েকজন অথবা কোনো মাসের চার থেকে পাঁচজন রোগীও ভর্তি হয়। ঈদের দিন রোগী এলেও আমাদে ফেরত যায় না। যেহেতু এই রোগ সংক্রমণ হয় তাই রোগী ও চিকিৎসক দুপক্ষই ভয় পায়। রোগীদের কাছ থেকেও এই রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু আমাদের চিকিৎসকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ২০১০ সাল থেকে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে রোগীদের চিকিৎসা দিয়ে আসছে।’

এ হাসপাতালে অফিস টাইম সকাল আটটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত। এই সময়ের পরেও রোগী এলে তাকে ভর্তি রাখা হয়। হাসপাতালে পরের দিন সকাল আটটার সময় তাকে টিকা দেওয়া দেয়। এখানে ১০০ শয্যার হাসপাতালে জলাতঙ্ক রোগীদের জন্য আলাদা ওয়ার্ড রয়েছে।’

জানা যায়, ২০২০ সালে কোভিডের জন্য জলাতঙ্ক রোগী কম ছিল। ২০২১ সালে প্রায় ৩৫ জন। আর ২০২২ সালে ৩৯ জনের মতো জলাতঙ্ক উপসর্গ নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু পাঁচশ থেকে ছয়শ রোগীদে টিকা দেওয়ার জন্য যে পরিমাণ চিকিৎসক দরকার সেটা এখানে ঘাটতি আছে।

সারা বাংলাদেশে সব সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জেলা সদর হাসপাতাল এবং উপজেলা হাসপাতালেও জলাতঙ্ক রোগের চিকিৎসা দেওয়া হয়। ১৯৭২ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১০০ শয্যার হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর আর সম্প্রসারণ করা হয়নি। আধুনিকতার বিন্দুমাত্র ছোঁয়া সেখানে লাগেনি। দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হলেও গুরুত্বপূর্ণ এই হাসপাতালের দিকে কারো নজর নেই।

জলাতঙ্ক কী: জলাতঙ্ক ভাইরাস জনিত একটি রোগ। এতে মৃত্যু অনিবার্য। বিশ্বে প্রতি ১০ মিনিটে একজন মানুষ জলাতঙ্ক রোগে মারা যায়। সঠিক ব্যবস্থাপনায় এটি শতভাগ প্রতিরোধযোগ্য।

চলতি বছরে কত টিকা দিয়েছে সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল

চলতি বছরের নয় মাসে এক লাখ ৮৭ হাজার ৭৮৪ জনকে টিকা দিয়েছে সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল। এর মধ্যে জানুয়ারি মাসে প্রথম ডোজ সাত হাজার ৭৭৪ জন, দ্বিতীয় ডোজ ছয় হাজার ৬০০ জন, তৃতীয় ডোজ পাঁচ হাজার ৯৯৬ জন, অতিরিক্ত ডোজ ৪২৪ জন, মোট ২০ হাজার ৭৯০ জন। ফেব্রুয়ারি মাসে প্রথম ডোজ সাত হাজার ৮৭ জন, দ্বিতীয় ডোজ ছয় হাজার ১২০ জন, তৃতীয় ডোজ পঁাঁচ হাজার ৪৪২ জন, অতিরিক্ত ডোজ ৪৮৭ জন, মোট ১৯ হাজার ১৩৬ জন। মার্চ মাসে সাত হাজার ৭৪৪ জন, দ্বিতীয় ডোজ ছয় হাজার ৭৩৮ জন, তৃতীয় ডোজ ছয় হাজার ১৭৭ জন, অতিরিক্ত ডোজ ৬০৫ জন, মোট ২১ হাজার ২৬৪ জন, এপ্রিল মাসে প্রথম ডোজ ছয় হাজার ৯৪৫ জন, দ্বিতীয় ডোজ পাঁচ হাজার ৮৩০ জন, তৃতীয় ডোজ পাঁচ হাজার ৩০০ জন, অতিরিক্ত ডোজ ৬০৯ জন, মোট ১৮ হাজার ৬৮৪ জন, মে মাসে প্রথম ডোজ আট হাজার ১২০ জন, দ্বিতীয় ডোজ সাত হাজার ২০৭ জন, তৃতীয় ডোজ ছয় হাজার ৬৬৬ জন, অতিরিক্ত ডোজ ৮০৩ জন, মোট ২২ হাজার ৭৬ জন, জুন মাসে প্রথম ডোজ ছয় হাজার ৭৫২ জন, দ্বিতীয় ডোজ ছয় হাজার ৪০০ জন, তৃতীয় ডোজ পাঁচ হাজার ৭৬০ জন অতিরিক্ত ডোজ ৫৮০ জন, মোট ১৯ হাজার ৪৯২ জন, জুলাই মাসে প্রথম ডোজ সাত হাজার ৭৭৩ জন, দ্বিতীয় ডোজ ছয় হাজার ১৬২ জন, তৃতীয় ডোজ পাঁচ হাজার ৬১০ জন, অতিরিক্ত ডোজ ৮১৫ জন, মোট ২০ হাজার ৩৬০ জন, আগস্ট মাসে প্রথম ডোজ সাত হাজার ১২৯ জন, দ্বিতীয় ডোজ ছয় হাজার ২০৪ জন, তৃতীয় ডোজ পাঁচ হাজার ৭৯৮ জন, অতিরিক্ত ডোজ ৭৬১ জন, মোট ১৯ হাজার ৮৯২ জন এবং সেপ্টেম্বর মাসে প্রথম ডোজ সাত হাজার ৪৮২ জন, দ্বিতীয় ডোজ ছয় হাজার ৩৩৫ জন, তৃতীয় ডোজ পাঁচ হাজার ৫৩০ জন, অতিরিক্ত ডোজ ৭৫৩ জন, মোট ২০ হাজার ১০০ জন।

কতজন চিকিৎসক আছেন হাসপাতালে

এই হাসপাতালে চিকিৎসক আছেন ১৭ জন, নার্স ৬০ জন, তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী আট থেকে ১০ জন, চতুর্থ শ্রেণির ২১ জন।

এ ব্যাপারে সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মোহাম্মদ মিজানুর রহমান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমরা রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার (সিডিসি) মেইন স্টেকহোল্ডার। জলাতঙ্ক রোগ নিয়ন্ত্রণ প্রোগ্রামের আওতায় ২০১০ সাল থেকে আমাদের কার্যক্রম চালু আছে। আমাদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক, সেবিকা এবং কনসালটেন্টদের সমান্বয়ে এই কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে। এখানে জনবলের অনেক ঘাটতি আছে। আমাদের যে অরগানোগ্রাম সেই অরগানোগ্রামের যথেষ্ট ঘাটতি আছে। বিভিন্ন পদ সৃজন করা দরকার। আমরা একটা জনবল নিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছিলাম ২০১৪ সালে। পরে আমি যোগদানের পরে এটাকে রিভাইসড করে এটাকে দিই। সেটা এখন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। সেখানে অনেকগুলো পদ সৃজনের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছিল। আমাদের অ্যাডজাস্টিং পদ ১৮৫টির বিপরীতে আরও ৪৮টি পদ সৃজনের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে। সেটার এখনও কোনো ফিডব্যাক পাইনি। আরেকটা আমাদের স্ট্যান্ডআপ স্যাটাপ যেটা ২০২১ সালে একটা করে পাঠানো হয়েছে। সেটাও আমাদের মন্ত্রণালয় থেকে এখনও ডাকেনি, মিটিং হয়নি। এটাও অনগোয়িং প্রসেস। চেষ্টা করছি এখানের জনবল বাড়ানোর জন্য।’

কতজন জনবল আছেন এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. মোহাম্মদ মিজানুর রহমান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমাদের চিকিৎসক আছেন কনসালটেন্টসহ ২০ জন। এরমধ্যে তিনজন আছেন, অন্যরা আছেন মেডিকেল অফিসার হিসেবে। সেবিকা আছেন ৭০ জন, তৃতীয় শ্রেণির আছেন তিনজন। আর চতুর্থ শ্রেণির অফিস সহায়কের ২৬টি পদের মধ্যে ২৩টি পদ শূন্য রয়েছে আর তিনটি পদ ফিলাপ আছে। অন্য পদের মধ্যে পরিছন্নতাকর্মীর ১৯টি পদ আছে। আর আয়ার পদও আছে।

(ঢাকাটাইমস/০৯নভেম্বর/এফএ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন এর সর্বশেষ

প্রতিমন্ত্রীর শ্যালকের অপহরণকাণ্ড: ১৬ দিনেও গ্রেপ্তার হননি আলোচিত লুৎফুল হাবীব

মে দিবস বোঝে না শ্রমিকরা, জানে ‘একদিন কাজ না করলে না খেয়ে থাকতে হবে’

গামছা বিক্রেতা থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক, মনে আছে সেই গোল্ডেন মনিরকে?

সোনার ধানের মায়ায় হাওরে নারী শ্রমে কৃষকের স্বস্তি

উপজেলা নির্বাচন নিয়ে কঠোর বার্তা দেবে আ. লীগ 

গরমে অতিষ্ঠ জনজীবন: চাহিদা বেড়েছে তরমুজের, ক্রেতা কম ডাবের

গাছ কাটার অপরাধে মামলা নেই 

কথায় কথায় মানুষ পেটানো এডিসি হারুন কোথায়? থানায় ছাত্রলীগ নেতাদের মারধরের তদন্ত কোথায় আটকে গেল?

মজুত ফুরালেই বাড়তি দামে বিক্রি হবে সয়াবিন তেল

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে ইরান-ইসরায়েল সংকট

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :