আরাভ খানকে দেশে ফেরাতে বাধা কোথায়

হাসান মেহেদী, ঢাকা টাইমস
 | প্রকাশিত : ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৯:০৩

বিদেশে পাড়ি জমানো ইন্টারপোলের রেড নোটিশভুক্ত ৪৭ শীর্ষ সন্ত্রাসীর মধ্যে আরাভ খানকেই দেখা যাচ্ছে প্রকাশ্যে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও সরব তিনি। দেশ থেকে নারীকর্মীও নিচ্ছেন দুবাইয়ের বুর্জোখলিফায়। এখন দুবাইয়ে আয়েশি জীবন কাটাচ্ছেন পুলিশ হত্যাসহ বিভিন্ন মামলার ওয়ারেন্টভুক্ত এই আসামি। বাংলাদেশের অনেক পরিচিত মুখও দেখা যাচ্ছে তার সঙ্গে। বারবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু এই আরাভ খানকে এখনো কেন দেশে ফেরানো যায়নি- তা নিয়ে সাধারণের কৌতূহল বেশ।

আরাভ ছাড়া বাংলাদেশি অন্য যে ৪৬ শীর্ষ সন্ত্রাসী ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল পুলিশ অর্গানাইজেশনের (ইন্টারপোল) রেড নোটিশভুক্ত, তাদের কখনোই প্রকাশ্যে আসতে দেখা যায় না। বিদেশেও আত্মগোপনে থেকে চলে তাদের কার্যক্রম। তবে আরাভ খান কেন ব্যতিক্রম? তার পেছনে কোন শক্তি রয়েছে- তা নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা রয়েছে দেশে।

আরাভ খান ইস্যুতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা কিছুদিন বেশ সরব থাকলেও সেসব আলোচনা কেন আড়ালে চলে গেল- প্রশ্ন উঠেছে তা নিয়েও।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ পুলিশের ডিআইজি (অপারেশনস) আনোয়ার হোসেন ঢাকা টাইমসকে বলেন, “আরাভ খানকে দেশে ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশ পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে। তাকে ফিরিয়ে এনে শাস্তির আওতায় আনতে পুলিশ সব ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আরাভ খানকে দেশে আনার কার্যক্রম চলমান রয়েছে।”

বাংলাদেশ পুলিশের আবেদনের ভিত্তিতে গত বছর মার্চ মাসে আরাভ খানের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করে ইন্টারপোল। এই রেড নোটিশ মাথায় নিয়ে আরাভ দীর্ঘ ১০ মাস ধরাছোঁয়ার বাইরে। দুবাইতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, করছেন ব্যবসা। খুলছেন নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান। তা ফলাও করে জানান দিচ্ছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

বিশ্বের বৃহত্তম আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোল। যার প্রধান কাজ আন্তর্জাতিক পুলিশকে সহায়তা করা। ইন্টারপোল বিশেষ করে পলাতক, জননিরাপত্তা এবং সন্ত্রাস, মাদক ও সংঘটিত অপরাধ, মানব পাচার ইত্যাদি অপরাধে জড়িতদের গ্রেপ্তারে অপারেশনাল কার্যক্রমে সহায়তা করে থাকে। আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের জরুরি সহায়তা করে এই সংস্থাটি।

তথ্য বলছে, কারও বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের রেড নোটিশ থাকলে তাকে যে দেশে খুঁজে পাওয়া যায় সে দেশ তার সম্পদ জব্দ, চাকরিচ্যুত এবং তার ভিসা প্রত্যাহার করে দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে আরাভের বিষয়ে দুবাই সরকার এখন পর্যন্ত সে ধরনের কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

আরাভ খানকে দেশে আনা সম্ভব জানিয়ে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজি) এ কে এম শহীদুল হক ঢাকা টাইমসকে বলেন, “যদি আরাভের সঠিক ঠিকানা বাংলাদেশ পুলিশ পায় তাহলে ইন্টারপোলের সহায়তা নিয়ে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে পারে। যদি সে দুবাইতে থাকে তাহলে ইন্টারপোল ও বাংলাদেশ পুলিশ দুবাই পুলিশকে অবগত করলে দুবাই পুলিশ আরাভ খানকে গ্রেপ্তার করতে পারবে।”

তিনি আরও বলেন, “সরকারের অনুমতি নিয়ে বাংলাদেশ পুলিশ চাইলে বিদেশে গিয়ে শীর্ষ অপরাধীদের খুঁজে বের করে দেশে আনতে পারে।” অপরাধ বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এই অপরাধীদের আইনের আওতায় আনার ধীরগতিতে দেশে অপরাধপ্রবণতা বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

জানা গেছে, রবিউল ইসলাম ওরফে আরাভ খানের বিরুদ্ধে ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, হত্যা ও অস্ত্র মামলাসহ গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া থানাতেই রয়েছে ৯টি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান শাহারিয়া আফরিন ঢাকা টাইমসকে বলেন, “সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছার অভাবে আরাভ খানের মতো অপরাধীরা দেশের বাইরে পাড়ি জমাতে পারছে। বিদেশে গিয়েও যখন তারা প্রকাশ্যে আসে তখন দেশে অপরাধপ্রবণতা চাঙ্গা হওয়ার আশঙ্কা থাকে। অপরাধীরা মনে করে থাকে, অপরাধ করেও প্রকাশ্যে থাকা যায়। তাই এসব অপরাধীকে দ্রুত সময়ের মধ্যে দেশে ফিরিয়ে এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনা উচিত।”

তিনি আরও বলেন, “আমাদের দেশে যখন অপরাধ হয় তখন সবাই নড়েচড়ে বসে, আবার কিছুদিন পর এসব ঘটনা সবাই ভুলে যেতে থাকে। ফলোআপের অভাবে অনেক কেইস চাপা পড়ে থাকে। তাই প্রতিটি অপরাধী ও অপরাধের ফলোআপ থাকা প্রয়োজন। আরাভ খানরা যখন দেশের বাইরে যায় তখন এর সঙ্গে অনেকের দায়িত্বে অবহেলা রয়েছে। সে তো পাসপোর্ট করে প্রকাশ্যে গিয়েছে। তখন যদি তাকে আটকানো যেত তাহলে সে দেশের বাইরে গিয়ে এভাবে প্রশাসনসহ সবাইকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখাতে পারতো না।”

তিনি বলেন, “দেশের বাইরে অপরাধীরা গেলে তাদের দেশে আনতে অনেক বেগ পেতে হয়। ইন্টারপোল পারে শুধু অপরাধীকে গ্রেপ্তারে সহায়তা করতে। তবে এই অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে সব সেক্টরকে কঠোর হতে হবে এবং মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। ২০১৮ সালের ৭ জুলাই পুলিশ হত্যার পরপরই ভারতে পালিয়ে রবিউল ইসলাম নাম পাল্টে হয়ে যান আরাভ খান। ২০২০ সালে তিনি ভুয়া তথ্য ব্যবহার করে ভারতীয় পাসপোর্ট জোগাড় করেন। এরপর সেখান থেকে দুবাইয়ে পাড়ি জমান। দুবাইতে আরাভ খান রয়েছেন ভারতীয় নাগরিক হিসেবে।”

গত বছর ৮ মে রমনা থানার অস্ত্র আইনের মামলায় ঢাকার বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১৪ এর বিচারক মুরশিদ আহমেদের আদালত আরাভ খানের ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেন।

২০১৫ সালের ২৮ জানুয়ারি মগবাজার এলাকায় শ্বশুর বাড়িতে অস্ত্র নিয়ে টাকা আদায় করতে যান আরাভ খান। এ ঘটনায় একটি রিভলবারসহ রমনা থানা পুলিশ তাকে আটক করে।

পরে ২০১৮ সালের ১৪ মার্চ উচ্চ আদালত থেকে জামিন পান। এরপর আদালতে হাজির না হলে বিচারক এই মামলায় আরাভের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। মামলাটি আদালতে বিচারাধীন।

২০১৮ সালের ৯ জুলাই গাজীপুরের একটি জঙ্গল থেকে পুলিশ পরিদর্শক মামুনের হাত-পা বাঁধা বস্তাবন্দি পোড়া মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ মামলায় আরাভ খানসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত। এ মামলায় আরাভ খান ছাড়া আরও ৯ জন আসামি রয়েছেন। এই মামলায় আরাভ খান পলাতক থাকায় তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়।

এসব বিষয়ে জানতে আরাভ খানের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করে, বার্তা পাঠিয়েও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

আরাভ খানকে দেশে ফেরানোর বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক সেহেলী সাবরীন বলেন, “আরাভকে প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া চলমান আছে। তাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কাজ করছে।”

তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান ঢাকা টাইমসকে বলেন, “দেশে মনিটরিং ব্যবস্থা খুবই দুর্বল, তাই অপরাধীরা সহজেই পার পেয়ে যাচ্ছে। অপরাধীদের বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ফলোআপ তেমন নেই বললেই চলে।”

তিনি বলেন, “দেশ থেকে অপরাধীরা পালানোর আগে প্রশাসনের সংশ্লিষ্টরা তেমন তৎপর থাকে না। যার জন্য খুব সহজেই অপরাধীরা দেশ ত্যাগ করতে পারছে। বারবার অপরাধ করে যখন অপরাধীরা জামিন পাচ্ছে, ছাড়া পাচ্ছে তখন তাদের কাছে অপরাধ করা ভাতমাছ হয়ে যায়।”

এদিকে আরাভ ইন্টারপোলের তালিকায় শীর্ষ সন্ত্রাসী হলেও গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার হিরণ ইউনিয়নে তার সুনাম রয়েছে। সেখানকার ইউপি সদস্য সাইফুদ্দিন মোল্লা ঢাকা টাইমসকে বলেন, “এলাকায় তার বিরুদ্ধে কোনো বদনাম নেই। তার বাবা মতিউর রহমান মোল্লা প্রায় ১০ বছর আগেও ভাঙ্গারির ব্যবসা করতেন। এলাকায় তাদের তেমন সম্পত্তি নেই। মাঝেমধ্যে তার বাবা-মা দুবাই গিয়ে আরাভের সঙ্গে দেখা করে আসেন।”

(ঢাকাটাইমস/০৬ফেব্রুয়ারি)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন এর সর্বশেষ

মে দিবস বোঝে না শ্রমিকরা, জানে ‘একদিন কাজ না করলে না খেয়ে থাকতে হবে’

গামছা বিক্রেতা থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক, মনে আছে সেই গোল্ডেন মনিরকে?

সোনার ধানের মায়ায় হাওরে নারী শ্রমে কৃষকের স্বস্তি

উপজেলা নির্বাচন নিয়ে কঠোর বার্তা দেবে আ. লীগ 

গরমে অতিষ্ঠ জনজীবন: চাহিদা বেড়েছে তরমুজের, ক্রেতা কম ডাবের

গাছ কাটার অপরাধে মামলা নেই 

কথায় কথায় মানুষ পেটানো এডিসি হারুন কোথায়? থানায় ছাত্রলীগ নেতাদের মারধরের তদন্ত কোথায় আটকে গেল?

মজুত ফুরালেই বাড়তি দামে বিক্রি হবে সয়াবিন তেল

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে ইরান-ইসরায়েল সংকট

ছাদ থেকে পড়ে ডিবি কর্মকর্তার গৃহকর্মীর মৃত্যু: প্রতিবেদনে আদালতকে যা জানাল পুলিশ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :