যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের পিডির পিএইচডি নিয়ে বিতর্ক

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ০৯ এপ্রিল ২০২৩, ০৯:৩১

বিতর্ক যেন পিছু ছাড়ছে না যুব উন্নয়নের অধিদপ্তরের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) এসএম আলমগীর কবিরের। আউটসোর্সিংয়ে প্রায় পাঁচশ’ জনবল নিয়োগে অবৈধ আর্থিক লেনদেনের অভিযোগের কোনো সুরাহা না হতেই এবার তার পিএইচডি ডিগ্রির সনদ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, তার পিএইচডি বৈধ নয়। তিনি ভুয়া পিএইচডি দেখিয়ে প্রভাষক থেকে এক লাফে সহযোগী অধ্যাপক, এরপর অধ্যাপক হয়েছিলেন।

শিক্ষাক্যাডারের কর্মকর্তা হয়েও আলমগীর কবির গত ২২ বছরের মধ্যে এক বছরও শিক্ষকতা করেননি। তার চাকরির পুরো সময়টুকু প্রেষণে কেটেছে প্রশাসনে। এর মাঝেই তিনি বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রির সনদ নেন। অথচ পিএইচডি করার জন্য তিনি কোনো ছুটিতেও যাননি। পিএইচডির জন্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অনুমতিও নেননি। কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেছেন তারও কোনো তথ্য দেননি। তাই তার পিএইচডি নিয়ে সন্দেহ ও বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে।

এসএম আলমগীর কবির এখন যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর বাস্তবায়নাধীন ‘দারিদ্র বিমোচনের লক্ষ্যে ব্যাপক প্রযুক্তিনির্ভর সমন্বিত সম্পদ ব্যবস্থাপনা (৩য় পর্যায়)’ শীর্ষক প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০০১ সালে ঝিনাদহের সরকারি কেশব চন্দ্র কলেজের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন আলমগীর কবির। প্রভাষক থেকে পিএইচডি দিয়ে এক লাফে সহযোগী অধ্যাপক, এরপর অধ্যাপক বনে যান। এরপর তিনি শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়ে মন্ত্রণালয়ে চাকরি নেন। খুব সহজে তিনি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রকল্পের পরিচালকের পদে আসীন হন। তবে নানান অপকর্মের জন্য পাঁচ বার ওএসডি হয়েছেন। নানা বিতর্কের পরও এখনও একটি প্রকল্পের পরিচালকের দায়িত্ব থাকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

মন্ত্রণালয় সূত্র মতে, এসএম আলমগীর কবির ঝিনাদহের সরকারি কেশব চন্দ্র কলেজের প্রভাষক হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন ২০০১ সালে ৩১ মে। শিক্ষক পদে যোগদানের পরপরই এই কর্মকর্তা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পিএস হিসেবে নিয়োগ পান ২০০১ সালের ২২ নভেম্বর। সংশ্লিষ্ট কলেজ থেকে রিলিজ হন ২৪ নভেম্বর। প্রতিমন্ত্রীর এপিএস হিসেবে যোগদান করেন ২০০২ সালের ৫ মার্চ। কিন্তু ওই কর্মকর্তার পিডিএসে প্রথম যোগদান ৩১ মে ২০০১ সঠিক দেখালেও কেসি কলেজ থেকে যোগদান ও রিলিজ দেখাচ্ছেন ২০০১ সালের ৩১ মে থেকে ২০০১ থেকে ২৪ নভেম্বর ২০০৫ সাল পর্যন্ত। অর্থাৎ তিনি ২০০১ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর এপিএস এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রেষণের সময়টুকু জালিয়াতি করে তা ঝিনাইদহের কেসি কলেজে দেখাচ্ছেন। এতে রাজনৈতিকভাবে নিয়োগ পাওয়া এপিএস হওয়ার সময়টুকু গোপন করতে চাচ্ছেন বলে অভিযোগ আছে।

এছাড়াও তিনি বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রি নিয়েছেন ২০০৬ সালে এবং একই সময় তিনি পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর এপিএস ছিলেন।

পিএইচডি ডিগ্রির বিষয়ে লিখেছেন বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু পিএইচডি কোন দেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নিয়েছেন তা উল্লেখ করেননি। তবে পরবর্তীতে এই পিএইচডি ডিগ্রি দিয়ে তিনি ১০% কোটায় প্রভাষক থেকে এক ধাপ ডিঙিয়ে ২০০৬ সালে সহযোগী অধ্যাপক পদোন্নতি নেন। অথচ পিএইচডি করতে হলে কমপক্ষে তিন বছরের ছুটি নিতে হয়। পিএইচডি করতে হলে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের অনুমোদন নিয়ে করতে হয়। এমনকি পিএইচডি করার আগে সরকারের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হয়। সেটিও তিনি নেননি বলে মাউশি সূত্রে জানা গেছে।

এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ও শিক্ষাবিদ ড. মোহাম্মদ তারিক আহসান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যারা পিএইচডি বা উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন তাদের একটি তালিকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে (মাউশি) সংরক্ষিত থাকে। পিএইচডি করতে হলে মাউশির অনুমোদন ও কমপক্ষে তিন বছরের ছুটি নিতে হয়। কেউ যদি শিক্ষা অধিদপ্তরের অনুমতি না নিয়ে পিএইচডি করতে যান সেটা রাষ্ট্রোদোহিতার শামিল।’

তিনি আরও বলেন, ‘কেউ পিএইচডি করার সময় তিনি সরকারি বেতনভুক্ত থাকেন। ভুয়া পিএইচডি ব্যবহার করে সহযোগী অধ্যাপক হওয়াটা অপরাধ।’

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘কেউ যদি পিএইচডি না করে এই ডিগ্রি ব্যবহার করে এটা অপরাধ। প্রমাণ পেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। পিএইচডি করতে হলে তিন বছরের ছুটি নিতে হয়। এছাড়া মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের অনুমোদন নিতে হয় এবং এসব কাগজপত্র শিক্ষা অধিদপ্তরে জমা থাকে। যারা বিদেশ থেকে পিএইচডি করে আসে তাদের পিএইচডি করার রেকর্ড শিক্ষা অধিদপ্তরে জমা থাকে। ভুয়া পিএইচডি করে সহযোগী অধ্যাপক হওয়ার প্রমাণ পেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১০ সালের ৭ জুলাই থেকে ২০১৪ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মাউশিতে ওএসডি ছিলেন আলমগীর কবির। কিন্তু কোথায় ছিলেন তা উল্লেখ নেই। ওই সময়টুকুতে তিনি পোস্ট ডক্টরেট ডিগ্রি করার জন্য ছুটিতে ছিলেন বলে মাউশিকে মৌখিকভাবে জানিয়েছেন। কিন্তু কোনো ডিগ্রির সনদ মাউশিতে তিনি জমা দেননি। মাউশির কর্মকর্তারা বলছেন, ২০০৯ সালে নতুন সরকার আসার পর তিনি আত্মগোপনে যাওয়ার জন্য ছুটি নেন। পরবর্তীতে সময় সুযোগ বুঝে আবার মাউশিতে যোগদান করেন।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং ওই কর্মকর্তার ব্যক্তিগত গোপনীয় তথ্য থেকে জানা গেছে, ২০০১ সালে তৎকালীন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর অভিপ্রায় অনুয়ায়ী এসএম আলমগীরকে সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) হিসেবে নিয়োগ দেয় তৎকালীন সংস্থাপন মন্ত্রণালয়।

অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে ১৫০০ কলেজে উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক হওয়ার আগে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ‘ইংলিশ ইন অ্যাকশন’ প্রকল্প পরিচালক ছিলেন। সেখানেও তিনি নানা জালিয়াতি করেছেন। এই প্রকল্প থেকে তিনি রিলিজ নেন ২০১৮ সালের ৫ এপ্রিল। অথচ প্রকল্প থেকে বেতন ভাতা নিয়েছেন ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত ‘ইংলিশ ইন অ্যাকশন প্রকল্প’ থেকে বেতন নেননি। তারপর তাকে মাদারীপুর সরকারি কলেজে বদলি করা হয়। সেখানে তার পদ না থাকায় তিনি যোগদান করতে পারেননি। এরপর ২০১৮ সালের ২৩ জুন তিনি ১৫০০ কলেজ প্রকল্পে যোগদান করেন। সেখানে প্রকল্পে বরাদ্দ না থাকার পরও জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৬ মাসের বেতন ভাতা জালিয়াতি করে নিয়েছেন তিনি। বিভিন্ন অপকর্মের অভিযোগে বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী দায়িত্ব পাওয়ার পরেই তাকে সরিয়ে দেন। তারপর তিনি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরে (মাউশি) ওএসডি ছিলেন। তার কিছুদিন পর অদৃশ্য শক্তিতে প্রথমে স্থানীয় সরকার ইন্সটিটিউটের উপ-পরিচালক এবং পরে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের আরেকটি প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে এখনও দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।

এসব প্রকল্প পরিচালক হয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন শত শত কোটি টাকা। রাজধানীসহ বিভিন্ন জায়গায় তার রয়েছে নামে বেনামে সম্পত্তির পাহাড়। ভুয়া পিএইচডি এবং প্রকল্পে অনিয়মের ব্যাপারে দ্রুত সময়ের মধ্যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে বলে মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।

এ অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে অনীহা প্রকাশ করেন আলমগীর কবির। ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, ‘এ বিষয় নিয়ে কথা বলার কী দরকার।’

এরপর পিএইচডির কাগজপত্র দেখানোর কথা বলে দু’সপ্তাহ পার করেন এই কর্মকর্তা। তবে সেই কাগজ আর তিনি দেখাতে পারেননি।

(ঢাকাটাইমস/০৯এপ্রিল/জেএ/আরআর/ইএস)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন এর সর্বশেষ

মে দিবস বোঝে না শ্রমিকরা, জানে ‘একদিন কাজ না করলে না খেয়ে থাকতে হবে’

গামছা বিক্রেতা থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক, মনে আছে সেই গোল্ডেন মনিরকে?

সোনার ধানের মায়ায় হাওরে নারী শ্রমে কৃষকের স্বস্তি

উপজেলা নির্বাচন নিয়ে কঠোর বার্তা দেবে আ. লীগ 

গরমে অতিষ্ঠ জনজীবন: চাহিদা বেড়েছে তরমুজের, ক্রেতা কম ডাবের

গাছ কাটার অপরাধে মামলা নেই 

কথায় কথায় মানুষ পেটানো এডিসি হারুন কোথায়? থানায় ছাত্রলীগ নেতাদের মারধরের তদন্ত কোথায় আটকে গেল?

মজুত ফুরালেই বাড়তি দামে বিক্রি হবে সয়াবিন তেল

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে ইরান-ইসরায়েল সংকট

ছাদ থেকে পড়ে ডিবি কর্মকর্তার গৃহকর্মীর মৃত্যু: প্রতিবেদনে আদালতকে যা জানাল পুলিশ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :