সেন্ট্রাল হাসপাতালে ভুল চিকিৎসা: ডা. সংযুক্তাকে গ্রেপ্তার ও হাসপাতালের লাইসেন্স বাতিলের দাবি
রাজধানীর গ্রিন রোডের সেন্ট্রাল হাসপাতালে ‘ভুল চিকিৎসায়’ নবজাতকের মৃত্যুর পর এবার না ফেরার দেশে চলে গেলেন মা মাহবুবা বাক্তার আঁখিও। ল্যাবএইড হাসপাতালে লাইফসাপোর্টে থাকা আঁখি রবিবার দুপুর ১ টা ৪৩ মিনিটে মারা যান বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। তবে ল্যাবএইড কর্তৃপক্ষ আঁখির মৃত্যুর কারণ স্পষ্ট করেনি উপস্থিত গণমাধ্যমের কাছে।
নবজাতকের মৃত্যুর পর মুমূর্ষু আঁখিকে সেন্ট্রাল হাসপাতাল থেকে ল্যাবএইডে স্থানান্তর করা হয়েছিল।
এদিকে এ ঘটনা তদন্তে ৭ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। যদিও গত শুক্রবার সেন্ট্রাল হাসপাতাল পরিদর্শন শেষে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি দল হাসপাতালটিতে সব ধরনের অস্ত্রোপচারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়।
সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে রাজধানীর সেন্ট্রাল হাসপাতালের চিকিৎসকদের অবহেলার শিকার মাহবুবা রহমান আঁখির নবজাতক সন্তান মারা যায় বলে জানায় পুলিশ। মাহবুবার অবস্থাও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে।
এ ঘটনায় ইতিমধ্যে চিকিৎসায় অবহেলায় নবজাতকের মৃত্যু ও মায়ের জীবন মৃত্যুঝুঁকিতে ফেলার অভিযোগে করা মামলায় ডা. শাহজাদী ও ডা. মুনা নামে দুজন চিকিৎসককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গত বৃহস্পতিবার তাদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এর আগে তারা ভুল চিকিৎসা ও প্রতারণার কথা স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
পাশাপাশি গত শুক্রবার সেন্ট্রাল হাসপাতালের সব ধরনের অস্ত্রোপচার বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। হাসপাতালটির নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) ও অস্ত্রোপচারের কক্ষ মানসম্পন্ন নয় বলে অধিদপ্তর এ নির্দেশ দিয়েছে।
যা ঘটেছিল
এ বিষয়ক মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ধানমন্ডি থানার পরিদর্শক রাসেল আদালতকে বলেন, মামলার বাদী ইয়াকুব আলী সুমনের স্ত্রী মাহাবুবা রহমান আঁখি গর্ভধারণের পর থেকেই ধানমন্ডি সেন্ট্রাল হসপিটালের অধ্যাপক ডা. সংযুক্তা সাহার (গাইনি) কাছে নিয়মিত চিকিৎসায় নিতেন। এ অবস্থায় গত ৯ জুন কুমিল্লার তিতাস উপজেলার অন্তঃসত্ত্বা মাহবুবা রহমান আঁখির (২৫) প্রসব বেদনা শুরু হয়। পরিবারের পক্ষ থেকে সেন্ট্রাল হাসপাতালের ডা. সংযুক্তা সাহার সহকারী মো. জমিরের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলে জানতে চাওয়া হয় তিনি (সংযুক্তা সাহা) হসপিটালে আছেন কি না। জমির আঁখির স্বামীকে জানান ডা. সংযুক্তা সাহা হসপিটালে আছেন এবং তাদের দ্রুত আসতে বলেন। পরে ইয়াকুব আলী তার স্ত্রীকে বাসা থেকে নিয়ে রাত সাড়ে ১২টার দিকে সেন্ট্রাল হসপিটালে ডা. সংযুক্তা সাহার চেম্বারের সামনে পৌঁছান।
সেসময় হসপিটালের চিকিৎসক ডা. মুনা সাহা বাদীকে জানান, ডা. সংযুক্তা সাহা লেবার ওয়ার্ডে আছেন। এই কথা বলে মাহাবুবা রহমানকে লেবার ওয়ার্ডে নিয়ে যান ডা. মুনা সাহা । সেসময় তাদের পেছনে পেছনে বাদীও লেবার ওয়ার্ডের সামনে যান। কিছুক্ষণ পর একজন নার্স লেবার ওয়ার্ড থেকে বের হয়ে ইয়াকুব আলীকে জানান, তার স্ত্রীকে হসপিটালে ভর্তি করাতে হবে। নার্সের এমন কথা শুনে, ইয়াকুব আলী ডা. সংযুক্তা সাহার অধীনে ভর্তি বাবদ ক্যাশ কাউন্টারে ১০ হাজার টাকা জমা দিয়ে মানি রিসিট লেবার ওয়ার্ডের নার্সের কাছে জমা দেন।
তিনি বলেন, এর কিছুক্ষণ পর ডা. শাহজাদী গাইনী ওয়ার্ডে এলে তার কাছে ইয়াকুব আলী নিজের স্ত্রীর শারীরিক অবস্থার কথা জানতে চান। কিন্তু ইয়াকুবের কথার কোনো উত্তর না দিয়ে তাকে গেটের বাইরে অপেক্ষা করতে বলেন ডা. শাহজাদী।
রাত ১টা ২০ মিনিট পর্যন্ত ইয়াকুবের স্ত্রীর শারীরিক অবস্থার কোনো খবর না পেয়ে একপর্যায়ে জোরপূর্বক লেবার ওয়ার্ডে প্রবেশ করেন। দেখেন ভেতরে কয়েকজন নার্স মিলে তার স্ত্রীকে দ্রুত গতিতে হাঁটাচলা করাচ্ছেন। এসময় ইয়াকুব নার্সদের জিজ্ঞেস করেন ডা. সংযুক্তা সাহা কোথায়। কিন্তু নার্সরা ইয়াকুবের কথার উত্তর না দিয়ে তাকে লেবার ওয়ার্ডের বাইরে অপেক্ষা করতে বলেন।
তদন্তকারী কর্মকর্তা আরও বলেন, এরপর রাত ২টা ৩০ মিনিটের দিকে ডা. শাহজাদী প্রসূতি আঁখিকে লেবার ওয়ার্ড থেকে বের করে অপারেশন থিয়েটারে (ওটিতে) নিয়ে যান। এসময় ডা. এহসান নামে আরও একজন চিকিৎসক ওটিতে প্রবেশ করেন। ওটিতে সিজারিয়ান অপারেশন শেষে ডা. শাহজাদী ইয়াকুব ও আঁখি দম্পতির নবজাতক শিশুকে (ছেলে) জীবিত অবস্থায় এনআইসিইউ নিয়ে যান। পরে রাত সাড়ে ৪টার দিকে একজন নার্স ওটি থেকে বের হয়ে ইয়াকুব আলীকে জানান, তার স্ত্রীর শারীরিক অবস্থা আশঙ্কাজনক তাই কিছু কাগজে তাকে সই দিতে হবে। কাগজে কেন সই দিতে হবে জানতে চাইলে নার্স ইয়াকুব আলীকে জানান, তার স্ত্রীকে বাঁচাতে হলে এই কাগজে সই করতে হবে। অন্যথায় ইয়াকুবের স্ত্রী আঁখি ও তার নবজাতকের চিকিৎসা তারা করবেন না। এই কথা শুনে নিরুপায় হয়ে স্ত্রী ও সন্তানের জীবন বাঁচাতে সেই কাগজে সই করেন ইয়াকুব আলী।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আদালতে বলেন, অধ্যাপক ডা. সংযুক্তা সাহার অনুপস্থিতিতে ওই রাতে আঁখির সিজারিয়ান অপারেশন কোনো চিকিৎসক করেছেন তা ইয়াকুব আলীকে জানানো হয়নি। এর মধ্যে ভোর ৪টা ৫০ মিনিটের দিকে আঁখির শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হলে তাকে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। এ ঘটনায় ইয়াকুব আলী বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে সেন্ট্রাল হসপিটালের ডেপুটি ডিরেক্টর মাসুদ পারভেজকে মৌখিকভাবে জানান।
এরপর ইয়াকুব তার স্ত্রী ও নবজাতকের শারীরিক অবস্থার কথা জানতে চাইলে এ বিষয়ে সেন্ট্রাল হসপিটাল কর্তৃপক্ষ তাকে কোনো তথ্য না দিয়ে আঁখিকে অন্য হসপিটালে চিকিৎসা করানোর জন্য বলে। ইয়াকুব সেন্ট্রাল হসপিটালের কোনো সহযোগিতা না পেয়ে পরে তার স্ত্রীকে ল্যাবএইড হসপিটালে ভর্তি করান। পরদিন অর্থাৎ ১০ জুন সেন্ট্রাল হসপিটালের কর্তৃপক্ষ ইয়াকুবকে জানায়, তার সন্তান বিকেল ৪টার দিকে এনআইসিইউতে মারা গেছে।
এ ঘটনায় ১৪ জুন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ধানমন্ডি থানায় সেন্ট্রাল হসপিটাল কর্তৃপক্ষের অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগ এনে একটি মামলা করেন ইয়াকুব আলী। মামলার আসামিরা হলেন, সেন্ট্রাল হসপিটালের ডা. মুনা সাহা (২৮), ডা. শাহজাদী মুস্তার্শিদা সুলতানা (৩৮), অধ্যাপক ডা. সংযুক্তা সাহার সহকারী মো. জমির, ডা. এহসান, ডা. মিলি ও সেন্ট্রাল হসপিটালের ম্যানেজার পারভেজসহ আরও অজ্ঞাত ৫-৬ জন। এর মধ্যে বুধবার এজাহারনামীয় দুই আসামি ডা. মুনা সাহা ও ডা. শাহজাদী মুস্তার্শিদা সুলতানাকে গ্রেপ্তার করেছে ধানমন্ডি থানা পুলিশ। গ্রেপ্তার আসামিদের ১৫ জুন আদালতে তুললে তাদের জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত।
ডা. সংযুক্তাকে গ্রেপ্তার ও সেন্ট্রালের লাইসেন্স বাতিলের দাবি
সেন্ট্রাল হসপিটালে ভুল চিকিৎসা ও কর্তৃপক্ষের প্রতারণায় ইডেন কলেজের ছাত্রী মাহবুবা রহমান আঁখির মৃত্যুর ঘটনায় ডা. সংযুক্তা সাহার গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন সহপাঠীরা। একইসঙ্গে সেন্ট্রাল হসপিটালের লাইসেন্স বাতিল করে একদিনের মধ্যে হাসপাতালটি বন্ধ করার দাবি জানিয়েছেন তারা। আঁখির মৃত্যুর খবরে গতকাল বিকালে রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে এসে এমন প্রতিক্রিয়া জানান তারা।
ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ মন্ত্রীর
ভুল চিকিৎসা ও কর্তৃপক্ষের প্রতারণায় মাহবুবা রহমান আঁখির মৃত্যুর ঘটনায় সেন্ট্রাল হসপিটালের বিরুদ্ধে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক। গতকাল বিকালে ভিটামিন এ প্লাস ক্যাম্পেইন কর্মসূচির উদ্বোধন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সেন্ট্রাল হসপিটালের ঘটনাটি আমাদের নজরে এসেছে। সেখানে একজন প্রসূতি মায়ের মৃত্যু খুবই দুঃখজনক।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, সেন্ট্রাল হসপিটালে আমরা টিম পাঠিয়েছিলাম, কী কী জিনিসের ঘাটতি ছিল সেখানে গিয়ে তারা সার্বিক অবস্থা দেখেছে। অপারেশনসহ কিছু কার্যক্রমও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যে পর্যন্ত তাদের ঘাটতিগুলো পূরণ না হবে সে পর্যন্ত তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে দেওয়া হবে না।
তিনি বলেন, সেন্ট্রাল হসপিটালের বিরুদ্ধে আমরা আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। এখন তো বিষয়টি পুরোপুরি আইনের হাতে চলে গেছে। এখন যা ব্যবস্থা নেওয়া হয়, সেটা আইনানুযায়ী নেওয়া হবে।
(ঢাকাটাইমস/১৮জুন/আরআর/আরকেএইচ/কেএম)