১৩ বছরে আগুনের ৯ ঘটনায় পাঁচ শতাধিক মৃত্যু, বিচার হয়নি একটিরও

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ০৭ এপ্রিল ২০২৩, ০৮:৪২

আগুন লাগে। হতাহত হয়। কিছুদিন তোলপাড়। সচেতনতা, আলোচনা। মামলাও হয়। আসামি গ্রেপ্তারও হয়। তবে দায়ীরা আসে না শাস্তির আওতায়। এর জন্য দুর্বল ধারায় মামলা, তদন্তে গাফিলতিকে দায় দিচ্ছেন বিশ্লেষকরা।

গত ১৩ বছরে ৯টি বড় ধরনের আগুনের ঘটনায় ৫০৩ জনের প্রাণহানি হয়েছে। এর মধ্যে একটি আগুনের ঘটনায় সাধারণ ডায়েরি বা জিডি হয়েছে। আর অন্য আটটি আগুনের ঘটনায় ১২টি মামলা হয়েছে।

আগুনের ঘটনাগুলোর মধ্যে ২০১০ সালে পুরান ঢাকার নিমতলীতে ১২৪ জন, ২০১২ সালে আশুলিয়ার তাজরীন ফ্যাশনে ১১৭ জন, ২০১৬ সালে টঙ্গীতে ট্যাম্পাকো ফয়েলস প্যাকেজিং কারখানায় ৩১ জন, ২০১৯ সালে চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ৭১ জন, একই বছরে বনানীর এফআর টাওয়ারে ২৬ জন এবং কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়া এলাকায় প্রাইম প্লাস্টিক কারখানায় ১৭ হন নিহত হন। ২০২১ সালে নারায়ণগঞ্জের হাসেম ফুড ফ্যাক্টরিতে ৫৪ জন এবং একই বছর রাজধানীর মগবাজারে একটি দোকানে বিস্ফোরণ থেকে সৃষ্ট আগুনে ১২ জন নিহত হন। এ ছাড়া ২০২২ সালে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম ডিপোতে লাগা আগুনে ৫১ ব্যক্তি নিহত হন। এই নয়টি ভয়াবহ আগুনের ঘটনায় শাস্তি হয়নি কারও। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় আগুন-ট্র্যাজেডি হিসেবে চিহ্নিত নিমতলীর ঘটনায় কোনো মামলাই হয়নি। কোনো কোনো মামলার তদন্তও শেষ হয়নি। দুয়েকটি ঘটনায় বিচার কার্যক্রম শুরু হলেও তা চলছে ঢিলেভাবে।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরশেদ ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘কেউ আগুন লাগিয়েছে এটা প্রমাণ করতে পারলেই তো বিচারের প্রশ্ন আসে। অধিকাংশ তদন্তে দেখা যায়, বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটসহ নানা ধরনের দুর্ঘটনার কথা বলা হয়। তবে কেউ রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ও ফায়ার সার্ভিসের নিয়ম নীতি ভঙ্গ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া যায়। এছাড়াও তাজরীন ফ্যাশনের ঘটনায় করা মামলায় তো ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক জেল খেটেছেন। তাদের একটা ক্ষতিপূরণও দিতে হয়েছিল। তারপরেও মামলাটি এখনও নিম্ন আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।’

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগুন লেগে হতাহতের ঘটনায় করা মামলাগুলো দীর্ঘদিনেও তদন্ত শেষ না হওয়ায় আলামত নষ্ট হয়। তদন্ত শেষে চার্জশিট দিলেও বিচার শুরুর পর সাক্ষীও খুঁজে পাওয়া যায় না। কারণ হতাহতদের বেশিরভাগই শ্রমিক বা ভাসমান মানুষ। এতে বিচার কার্যক্রমে বাধার সৃষ্টি হয়।

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টে চর্চা করেন এমন এক আইনজীবী বলেন, অধিকাংশ আগুন লাগার ঘটনায় দেখা যায়, যাদের ইচ্ছাকৃত অবহেলা বা অবকাঠামোগত কারণে আগুন লাগে বা হতাহতের ঘটনার পেছনে যারা জড়িত থাকেন তারা আর্থিকভাবে খুবই শক্তিশালী হন। এতে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি প্রতিপক্ষের সঙ্গে আইনি লড়াইয়ে পেরে ওঠেন না।

এই আইনজীবী বলেন, ‘যে কোনো ফৌজদারি অপরাধের বিচার করার দায় রাষ্ট্রের। মামলা করা থেকে শুরু করে তদন্ত, মৌখিক ও দালিলিক সাক্ষ্য উপস্থাপন সবই করার দায়িত্ব হলো রাষ্ট্রের। ফৌজদারি মামলার বিচার না হলে, শাস্তি নিশ্চিত না হলে রাষ্ট্রকেই দায় নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে মামলার ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ শুধু তাগিদ দিতে পারে।’

এই আইনজীবী ভাষ্য, আগুন লাগার পর ভবনের মালিকের বিরুদ্ধে কিছু ব্যতিক্রম হিসেবে হত্যা মামলা হয়েছে। কিন্তু সরকারি যেসব কর্তৃপক্ষের ইচ্ছাকৃত অবহেলা থাকে তাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয় না। তাদের শাস্তি হয় না। তারা শাস্তির ঊর্ধ্বে থেকে যান। দায়িত্বে অবহেলাকারীদের শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে হয়তো অবহেলায় আগুন লাগে আর অবহেলাজনিত মৃত্যু কমে আসবে।

আগুনের ঘটনায় একাধিক মামলার আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভবনের অবকাঠামোগত ত্রুটি, অবৈধ কেমিকেল গুদাম বা অবহেলায় বৈদ্যুতিক গোলোযোগের ঘটনায় অগ্নিকাণ্ডে হতাহত হলে রাজউক, বিস্ফোরক অধিদপ্তর এবং ফায়ার সার্ভিসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আদালতে সাক্ষী দিয়ে প্রমাণ করতে হয়। কিন্তু এই ধরনের আগুন লাগার ঘটনা এসব সংস্থার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদেরও অবহেলা থেকে যায়। এজন্য তাদেরও সাক্ষী হিসেবে পাওয়া যায় না।

নিমতলীতে লাগা আগুনে ১২৪ জন প্রাণ হারানোর ঘটনায় শুধু বংশাল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি হয়। এর ভিত্তিতে পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হলেও জিডির আর তদন্ত হয়নি। তাজরীন ফ্যাশন কারখানায় আগুনের ঘটনায় প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেলোয়ার হোসেন ও তার স্ত্রীসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। পুলিশ ওই মামলায় চার্জশিট দিলেও গত ১১ বছরে বিচার কাজ শেষ হয়নি। ওই মামলায় ১০৪ জন সাক্ষীর মধ্যে হাতেগোনা কয়েকজন সাক্ষ্য দিয়েছেন। দেলোয়ার গ্রেপ্তার হলেও জামিনে বেরিয়ে তিনি এখন মৎস্যজীবী লীগের নেতা।

চুড়িহাট্টার ঘটনায় চার্জশিট জমা দেওয়ার এক বছর পর বিচার কার্যক্রম শুরু হলেও সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়নি। হাসেম ফুড কারখানার ঘটনায় করা মামলার তদন্তই শেষ হয়নি এক বছরে। সাড়ে তিন বছর ধরে চলছে এফআর টাওয়ারের আগুনে হতাহত ঘটনায় করা মামলার তদন্ত। দেড় বছরে শেষ হয়নি মগবাজারে বিস্ফোণে হতাহতের ঘটনায় করা মামলার তদন্ত। এ ছাড়া ট্যাম্পাকো ফয়েলস প্যাকেজিং কারখানা ও প্রাইম প্লাস্টিক কারখানায় হতাহতেরও বিচার হয়নি। এখনো তদন্ত চলছে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম ডিপোতে লাগা আগুনের ঘটনায় করা মামলায়।

(ঢাকাটাইমস/০৭এপ্রিল/এএ/কেএম)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন এর সর্বশেষ

মে দিবস বোঝে না শ্রমিকরা, জানে ‘একদিন কাজ না করলে না খেয়ে থাকতে হবে’

গামছা বিক্রেতা থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক, মনে আছে সেই গোল্ডেন মনিরকে?

সোনার ধানের মায়ায় হাওরে নারী শ্রমে কৃষকের স্বস্তি

উপজেলা নির্বাচন নিয়ে কঠোর বার্তা দেবে আ. লীগ 

গরমে অতিষ্ঠ জনজীবন: চাহিদা বেড়েছে তরমুজের, ক্রেতা কম ডাবের

গাছ কাটার অপরাধে মামলা নেই 

কথায় কথায় মানুষ পেটানো এডিসি হারুন কোথায়? থানায় ছাত্রলীগ নেতাদের মারধরের তদন্ত কোথায় আটকে গেল?

মজুত ফুরালেই বাড়তি দামে বিক্রি হবে সয়াবিন তেল

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে ইরান-ইসরায়েল সংকট

ছাদ থেকে পড়ে ডিবি কর্মকর্তার গৃহকর্মীর মৃত্যু: প্রতিবেদনে আদালতকে যা জানাল পুলিশ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :